শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫

পৃথিবীতে কোন মৌলের প্রাচুর্যতা সবচেয়ে বেশি?

মৌলের

পৃথিবী বিভিন্ন মৌলের সমন্বয়ে গঠিত, যা প্রাকৃতিকভাবে বা মানুষের দ্বারা তৈরি হতে পারে। বর্তমানে পর্যায় সারণিতে ১১৮টি মৌল শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯২টি মৌল প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীতে পাওয়া যায়, আর বাকি ২৬টি ল্যাবে তৈরি করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই প্রাকৃতিক মৌলগুলোর মধ্যে কোনটি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়?

ভূত্বকে মৌলের প্রাচুর্যতা

পৃথিবীর ভূত্বক গঠিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মৌল ও যৌগের সংমিশ্রণে। এই ভূত্বক আমাদের জন্য শুধু একটি পৃষ্ঠই নয়, এটি মানবজাতি এবং সমগ্র জীবজগতের বেঁচে থাকার মৌলিক ভিত্তি। ভূত্বকের গঠনে কিছু নির্দিষ্ট মৌল সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিদ্যমান। নিচে ভূত্বকের পাঁচটি প্রধান মৌলের তালিকা ও তাদের ভূমিকা আলোচনা করা হলো।

১. অক্সিজেন (৪৬%)
পৃথিবীর ভূত্বকের মোট ভরের প্রায় ৪৬% অক্সিজেন নিয়ে গঠিত। এটি ভূত্বকের সবচেয়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং শিলা ও খনিজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অক্সিজেন সিলিকেট, কার্বনেট এবং অন্যান্য খনিজের সঙ্গে মিশে গঠন করে পৃথিবীর কঠিন স্তর। এটি জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌল, যা আমাদের দেহের গঠনেরও প্রধান উপাদান।

২. সিলিকন (২৭%)
অক্সিজেনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সিলিকন, যা ভূত্বকের ২৭% গঠন করে। সিলিকন শিলা, বালি এবং সিলিকেট খনিজের প্রধান উপাদান। এটি আধুনিক প্রযুক্তিতেও গুরুত্বপূর্ণ, যেমন সিলিকন চিপের ব্যবহার, যা কম্পিউটারের মূল উপাদান। সিলিকনের উপস্থিতি ভূত্বকের শক্ত কাঠামো বজায় রাখতে সহায়তা করে।

৩. অ্যালুমিনিয়াম (৮%)
অ্যালুমিনিয়াম ভূত্বকের ৮% গঠন করে। এটি হালকা, শক্তিশালী এবং সহজে গঠনযোগ্য হওয়ায় নির্মাণ শিল্প এবং বিভিন্ন প্রযুক্তিগত কাজে বহুল ব্যবহৃত। অ্যালুমিনিয়াম প্রধানত বোক্সাইট খনিজ থেকে পাওয়া যায়। এটি পৃথিবীর ভূত্বকের এক অপরিহার্য উপাদান।

৪. আয়রন (লোহা) (৫%)
ভূত্বকের ৫% আয়রন বা লোহা দ্বারা গঠিত। এটি হেমাটাইট এবং ম্যাগনেটাইটের মতো খনিজে পাওয়া যায়। আয়রন পৃথিবীর কেন্দ্রীয় কোরেও প্রচুর পরিমাণে উপস্থিত এবং পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র তৈরিতে ভূমিকা পালন করে। এছাড়া লোহার বিভিন্ন অক্সাইড শিলা ও মাটিতে লালচে রং তৈরি করে।

৫. ক্যালসিয়াম (৫%)
ভূত্বকের আরও ৫% ক্যালসিয়াম দ্বারা গঠিত। এটি প্রধানত চুনাপাথর, ক্যালসাইট এবং জিপসামের মতো খনিজে উপস্থিত। ক্যালসিয়াম উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি মৌল। এছাড়া এটি ভূত্বকের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করে।

বায়ুমণ্ডলে মৌলের প্রাচুর্যতা

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আমাদের চারপাশের গ্যাসীয় স্তর, যা জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তর বিভিন্ন ধরনের গ্যাসের সংমিশ্রণে গঠিত, যার মধ্যে পাঁচটি মৌলের পরিমান সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান। এদের প্রত্যেকেরই বায়ুমণ্ডলের গঠন ও প্রাণের অস্তিত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

১. নাইট্রোজেন (৭৮%)
বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে প্রচুর গ্যাস হলো নাইট্রোজেন, যা বায়ুর ৭৮% গঠন করে। এটি একটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং সহজে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। নাইট্রোজেন জীবনের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি প্রোটিন এবং ডিএনএর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উদ্ভিদ নাইট্রোজেন শোষণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করে, যা খাদ্যশৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. অক্সিজেন (২১%)
বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় সর্বাধিক গ্যাস হলো অক্সিজেন, যা বায়ুর ২১% গঠন করে। এটি জীবজগতের জন্য অপরিহার্য, কারণ আমরা অক্সিজেন শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করি। অক্সিজেন জ্বলন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে এবং জীবের শক্তি উৎপাদনেও সহায়তা করে। এছাড়া এটি ওজোন স্তর তৈরিতে সহায়তা করে, যা সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে।

৩. আর্গন (০.৯৩%)
তৃতীয় সর্বাধিক উপস্থিত গ্যাস হলো আর্গন, যা বায়ুমণ্ডলের প্রায় ০.৯৩% গঠন করে। এটি একটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। আর্গন প্রাথমিকভাবে পৃথিবীর ভূত্বক থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং বায়ুমণ্ডলে স্থায়ী হয়েছে। এটি সাধারণত শিল্পক্ষেত্রে, বিশেষত ওয়েল্ডিং ও বৈদ্যুতিক বাতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

৪. কার্বন ডাই-অক্সাইড (০.০৪%)
কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের চতুর্থ প্রধান গ্যাস, যা মোট গ্যাসের ০.০৪% গঠন করে। যদিও এর পরিমাণ খুব কম, এটি গ্রিনহাউস প্রভাব এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড অপরিহার্য, যা খাদ্যশৃঙ্খলে প্রথম ধাপ তৈরি করে।

৫. নিয়ন (০.০০১৮%)
পঞ্চম স্থানে রয়েছে নিয়ন, যা বায়ুমণ্ডলের মাত্র ০.০০১৮% গঠন করে। এটি একটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং আলোক প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়। নিয়ন বাতি এবং বিজ্ঞাপনী লাইট তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত। এটি বায়ুমণ্ডলে অত্যন্ত কম মাত্রায় উপস্থিত হলেও এর গুরুত্ব কম নয়।

পৃথিবীর ভূত্বকে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় অক্সিজেন, আর বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন। পৃথিবীর ভূত্বকের পাঁচটি মৌলের- অক্সিজেন, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, আয়রন, এবং ক্যালসিয়াম- একসঙ্গে পৃথিবীর কঠিন স্তরের মূল কাঠামো তৈরি করেছে। এরা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। পৃথিবীর গঠন এবং জীবনের জন্য এই মৌলগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের উপস্থিতি ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, আর্গন, কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং নিয়ন সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিদ্যমান। এদের প্রত্যেকটি বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষা এবং জীবজগতের অস্তিত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মৌলের কারণের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল জীবনধারণের উপযোগী হয়েছে। এই মৌলগুলো প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা এবং মানব সভ্যতার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Email
স্বর্ণ কেনো এতো দামী
বিজ্ঞান

স্বর্ণ কেনো এতো দামী? স্বর্ণের উৎপত্তি, ব্যবহার ও গুরুত্ব

স্বর্ণ বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান ধাতু, যা প্রাচীনকাল থেকে মানুষের কাছে সমাদৃত। স্বর্ণের উচ্চমূল্যের কারণ বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, স্বর্ণের প্রাপ্যতা খুবই সীমিত।

Read More »
মস্তিষ্ক কাচে পরিণত
বিজ্ঞান

মানুষের মস্তিষ্ক কাচে পরিণত হয়েছে আগ্নেয়গিরির তাপের প্রভাবে

মস্তিষ্ক কাচে পরিণত হয় প্রায় ২,০০০ বছর আগে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে প্রাণ হারানো এক যুবকের। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, তার মস্তিষ্ক সংরক্ষিত হয়েছিল এবং উচ্চ তাপমাত্রার

Read More »
চার্লস ডারউইন
বিজ্ঞান

চার্লস ডারউইন: আধুনিক জীববিজ্ঞানের পথিকৃৎ

চার্লস ডারউইন Charles Darwin (১৮০৯-১৮৮২) ছিলেন একজন ইংরেজ প্রকৃতিবিদ, ভূতত্ত্ববিদ এবং জীববিজ্ঞানী, যিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। তাঁর গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ আধুনিক

Read More »
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড
ভূগোল

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড: জীববৈচিত্র্যের এক অমূল্য রত্ন

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড মেরিন সংরক্ষিত এলাকা (Swatch of No Ground Marine Protected Area) বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের একটি গভীর খাদ বা সাগরবদ্ধ এলাকা, যা ২০১৪ সালের

Read More »
জলবায়ু পরিবর্তন
ঝুঁকি

বৈশ্বিক সমস্যা জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধ হবে কী?

জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change) একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা বিশ্বব্যাপী পরিবেশ, প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তন মূলত পৃথিবীর সাধারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি,

Read More »
সমুদ্র ফেনা
প্রকৃতি

সমুদ্র ফেনা: একটি প্রাকৃতিক বিস্ময়

সমুদ্র ফেনা সাধারণত উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতে দেখা যায়। এটি সমুদ্রের পানির উপরের স্তরে তৈরি হওয়া এক ধরনের ফেনিল স্তর। যখন সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত জৈব উপাদান, যেমন

Read More »
প্যারটফিশের মল
প্রাণীজগৎ

প্যারটফিশের মল সমুদ্রসৈকতের সাদা বালির গোপন উপাদান

তপ্ত রোদে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দে ভরা একটি সাদা বালুর সৈকতে হাঁটার অনুভূতি অনন্য। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই সুন্দর সাদা বালির পেছনে আছে প্রকৃতির এক

Read More »
আগুন
বিজ্ঞান

আগুন আসলে কী?

আগুন এমন এক জিনিস যা দেখলে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। এর নাচানাচি, উজ্জ্বলতা, শক্তি এবং রহস্যময়তা আমাদের মোহিত করে। কখনও বিপজ্জনক, কখনও প্রশান্তিদায়ক—আগুন আমাদের জন্য

Read More »
বুনো মান্দার
নিবন্ধ

ফুলেভরা বুনো মান্দার

মাঝে মাঝে নির্জন কোন সবুজ বনের পথ দিয়ে হেঁটে চলার সময় দেখা হয়ে যায় হলুদ কিম্বা লাল রঙের ফুলেভরা কোন বৃক্ষের সঙ্গে। বনতল থেকে উপরের

Read More »
অর্কিড
প্রকৃতি

নতুন অর্কিড পেল বাংলাদেশ

বাংলাদেশের বন-বাদারে প্রায় ১৭৮ প্রজাতির অর্কিড জন্মে (সূত্র: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ, খণ্ড-১২)। বাংলাদেশের অর্কিডের তালিকায় যুক্ত হলো নতুন একটি প্রজাতি ইউলোফিয়া অবটিউজা (Eulophia

Read More »