পৃথিবী বিভিন্ন মৌলের সমন্বয়ে গঠিত, যা প্রাকৃতিকভাবে বা মানুষের দ্বারা তৈরি হতে পারে। বর্তমানে পর্যায় সারণিতে ১১৮টি মৌল শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯২টি মৌল প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীতে পাওয়া যায়, আর বাকি ২৬টি ল্যাবে তৈরি করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই প্রাকৃতিক মৌলগুলোর মধ্যে কোনটি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়?
ভূত্বকে মৌলের প্রাচুর্যতা
পৃথিবীর ভূত্বক গঠিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মৌল ও যৌগের সংমিশ্রণে। এই ভূত্বক আমাদের জন্য শুধু একটি পৃষ্ঠই নয়, এটি মানবজাতি এবং সমগ্র জীবজগতের বেঁচে থাকার মৌলিক ভিত্তি। ভূত্বকের গঠনে কিছু নির্দিষ্ট মৌল সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিদ্যমান। নিচে ভূত্বকের পাঁচটি প্রধান মৌলের তালিকা ও তাদের ভূমিকা আলোচনা করা হলো।
১. অক্সিজেন (৪৬%)
পৃথিবীর ভূত্বকের মোট ভরের প্রায় ৪৬% অক্সিজেন নিয়ে গঠিত। এটি ভূত্বকের সবচেয়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং শিলা ও খনিজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অক্সিজেন সিলিকেট, কার্বনেট এবং অন্যান্য খনিজের সঙ্গে মিশে গঠন করে পৃথিবীর কঠিন স্তর। এটি জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌল, যা আমাদের দেহের গঠনেরও প্রধান উপাদান।
২. সিলিকন (২৭%)
অক্সিজেনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সিলিকন, যা ভূত্বকের ২৭% গঠন করে। সিলিকন শিলা, বালি এবং সিলিকেট খনিজের প্রধান উপাদান। এটি আধুনিক প্রযুক্তিতেও গুরুত্বপূর্ণ, যেমন সিলিকন চিপের ব্যবহার, যা কম্পিউটারের মূল উপাদান। সিলিকনের উপস্থিতি ভূত্বকের শক্ত কাঠামো বজায় রাখতে সহায়তা করে।
৩. অ্যালুমিনিয়াম (৮%)
অ্যালুমিনিয়াম ভূত্বকের ৮% গঠন করে। এটি হালকা, শক্তিশালী এবং সহজে গঠনযোগ্য হওয়ায় নির্মাণ শিল্প এবং বিভিন্ন প্রযুক্তিগত কাজে বহুল ব্যবহৃত। অ্যালুমিনিয়াম প্রধানত বোক্সাইট খনিজ থেকে পাওয়া যায়। এটি পৃথিবীর ভূত্বকের এক অপরিহার্য উপাদান।
৪. আয়রন (লোহা) (৫%)
ভূত্বকের ৫% আয়রন বা লোহা দ্বারা গঠিত। এটি হেমাটাইট এবং ম্যাগনেটাইটের মতো খনিজে পাওয়া যায়। আয়রন পৃথিবীর কেন্দ্রীয় কোরেও প্রচুর পরিমাণে উপস্থিত এবং পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র তৈরিতে ভূমিকা পালন করে। এছাড়া লোহার বিভিন্ন অক্সাইড শিলা ও মাটিতে লালচে রং তৈরি করে।
৫. ক্যালসিয়াম (৫%)
ভূত্বকের আরও ৫% ক্যালসিয়াম দ্বারা গঠিত। এটি প্রধানত চুনাপাথর, ক্যালসাইট এবং জিপসামের মতো খনিজে উপস্থিত। ক্যালসিয়াম উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি মৌল। এছাড়া এটি ভূত্বকের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করে।
বায়ুমণ্ডলে মৌলের প্রাচুর্যতা
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আমাদের চারপাশের গ্যাসীয় স্তর, যা জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তর বিভিন্ন ধরনের গ্যাসের সংমিশ্রণে গঠিত, যার মধ্যে পাঁচটি মৌলের পরিমান সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান। এদের প্রত্যেকেরই বায়ুমণ্ডলের গঠন ও প্রাণের অস্তিত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
১. নাইট্রোজেন (৭৮%)
বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে প্রচুর গ্যাস হলো নাইট্রোজেন, যা বায়ুর ৭৮% গঠন করে। এটি একটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং সহজে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। নাইট্রোজেন জীবনের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি প্রোটিন এবং ডিএনএর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উদ্ভিদ নাইট্রোজেন শোষণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করে, যা খাদ্যশৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. অক্সিজেন (২১%)
বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় সর্বাধিক গ্যাস হলো অক্সিজেন, যা বায়ুর ২১% গঠন করে। এটি জীবজগতের জন্য অপরিহার্য, কারণ আমরা অক্সিজেন শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করি। অক্সিজেন জ্বলন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে এবং জীবের শক্তি উৎপাদনেও সহায়তা করে। এছাড়া এটি ওজোন স্তর তৈরিতে সহায়তা করে, যা সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে।
৩. আর্গন (০.৯৩%)
তৃতীয় সর্বাধিক উপস্থিত গ্যাস হলো আর্গন, যা বায়ুমণ্ডলের প্রায় ০.৯৩% গঠন করে। এটি একটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। আর্গন প্রাথমিকভাবে পৃথিবীর ভূত্বক থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং বায়ুমণ্ডলে স্থায়ী হয়েছে। এটি সাধারণত শিল্পক্ষেত্রে, বিশেষত ওয়েল্ডিং ও বৈদ্যুতিক বাতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
৪. কার্বন ডাই-অক্সাইড (০.০৪%)
কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের চতুর্থ প্রধান গ্যাস, যা মোট গ্যাসের ০.০৪% গঠন করে। যদিও এর পরিমাণ খুব কম, এটি গ্রিনহাউস প্রভাব এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড অপরিহার্য, যা খাদ্যশৃঙ্খলে প্রথম ধাপ তৈরি করে।
৫. নিয়ন (০.০০১৮%)
পঞ্চম স্থানে রয়েছে নিয়ন, যা বায়ুমণ্ডলের মাত্র ০.০০১৮% গঠন করে। এটি একটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং আলোক প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়। নিয়ন বাতি এবং বিজ্ঞাপনী লাইট তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত। এটি বায়ুমণ্ডলে অত্যন্ত কম মাত্রায় উপস্থিত হলেও এর গুরুত্ব কম নয়।
পৃথিবীর ভূত্বকে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় অক্সিজেন, আর বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন। পৃথিবীর ভূত্বকের পাঁচটি মৌলের- অক্সিজেন, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, আয়রন, এবং ক্যালসিয়াম- একসঙ্গে পৃথিবীর কঠিন স্তরের মূল কাঠামো তৈরি করেছে। এরা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। পৃথিবীর গঠন এবং জীবনের জন্য এই মৌলগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের উপস্থিতি ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, আর্গন, কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং নিয়ন সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিদ্যমান। এদের প্রত্যেকটি বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষা এবং জীবজগতের অস্তিত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মৌলের কারণের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল জীবনধারণের উপযোগী হয়েছে। এই মৌলগুলো প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা এবং মানব সভ্যতার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।