এনিয়াক (ENIAC) বা ইলেক্ট্রনিক নিউমেরিক্যাল ইন্টিগ্রেটর অ্যান্ড কম্পিউটার বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার। এটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯৪৩ সালে এবং ১৯৪৫ সালে সফলভাবে চালু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকার সেনাবাহিনীর গোলা নিক্ষেপের ক্যালকুলেশনকে আরও দ্রুত এবং সুনির্দিষ্ট করার জন্য এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। জন ডব্লিউ মক্লি এবং জে. প্রেসপার একার্ট এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন।
এনিয়াক প্রকল্পটি মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি গোপন প্রকল্প ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, এটি তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধের সময় ব্যালিস্টিক ক্যালকুলেশন দ্রুততর করার জন্য। তবে, এই প্রকল্প সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও জানতেন না। নির্মাণকালে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়, যা এটিকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
এনিয়াক একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল, কারণ এটি ছিল প্রথম মেশিন যা সম্পূর্ণরূপে ইলেকট্রনিক এবং প্রোগ্রামেবল। এটি ৩০ টন ওজনের একটি যন্ত্র, যার দৈর্ঘ্য ছিল ৮০ ফুট এবং এতে প্রায় ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হয়েছিল।
এনিয়াক নির্মাণে প্রায় ৫,০০,০০০ মার্কিন ডলার খরচ হয়েছিল, যা বর্তমানে প্রায় ৭ মিলিয়ন ডলারের সমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এত বড় বাজেটের প্রকল্প পরিচালনা করা ছিল আমেরিকান সেনাবাহিনীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে যুদ্ধকালীন জরুরি প্রয়োজনের কারণে সরকার এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে রাজি হয়।
১৯৪০-এর দশকে, মানুষের কাছে ধারণাই ছিল না যে একটি মেশিন এত দ্রুত গণনা করতে পারে। এনিয়াক এক সেকেন্ডে ৫,০০০ যোগ-বিয়োগ করতে সক্ষম ছিল। এটি এমন একটি ক্ষমতা ছিল যা ঐ সময়ের যেকোনো ক্যালকুলেটরের তুলনায় বহু গুণ বেশি। এনিয়াকে প্রোগ্রাম করা হত ম্যানুয়ালি তারের মাধ্যমে। এতে কোনও সংরক্ষণ ক্ষমতা (মেমরি) ছিল না, তবে প্রোগ্রামিং পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করা সম্ভব হত। অনেকে এটিকে “যান্ত্রিক ব্রেন” বলে অভিহিত করত এবং এর কাজ করার পদ্ধতি নিয়ে কৌতূহলী ছিল। কিছু মানুষের ধারণা ছিল, এনিয়াক হয়তো “আত্মনির্ভরশীল” হয়ে উঠতে পারে, যা পরবর্তীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণার সূচনা করে।
এনিয়াকে প্রায় ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হয়েছিল। এই টিউবগুলোর মধ্যে কোনো একটি বিকল হয়ে গেলে পুরো যন্ত্রটি বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এত বিশাল পরিমাণ টিউব থাকা সত্ত্বেও এনিয়াক বেশিরভাগ সময় সঠিকভাবে কাজ করত। বিজ্ঞানীরা এখনো অবাক হন, কীভাবে এটি এত দীর্ঘ সময় ধরে কার্যকর ছিল। অনেকে একে “প্রযুক্তির মিরাকল” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
এনিয়াকের পরিচালনার পেছনে কাজ করতেন ছয়জন নারী প্রোগ্রামার—ক্যাথরিন ক্লিপার, জিন জেনিংস, বেটি স্নাইডার, মারলিন ওয়েসকফ, রুথ লিচ্টারম্যান এবং ফ্রান্সেস বিলাস। তাদের কাজ ছিল এনিয়াককে প্রোগ্রামিং করা এবং এটি ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা নিশ্চিত করা। তবে, দীর্ঘদিন ধরে তাদের অবদান অপ্রকাশিত ছিল। পরে, নারীদের এই অবদান প্রযুক্তি জগতে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।
এনিয়াকের সৃষ্টির সময় যে প্রযুক্তি এবং নকশা ব্যবহার করা হয়েছিল, তা এতটাই আধুনিক ছিল যে বিজ্ঞানীরা এখনও বিশ্বাস করেন, এটি বর্তমান কম্পিউটার প্রযুক্তির ভিত্তি। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে সেই সময়ে এত অগ্রসর প্রযুক্তি সম্ভব হয়েছিল? অনেকেই একে “সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা একটি প্রকল্প” বলে আখ্যায়িত করেন। এমনকি কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদ দাবি করেন, এই জ্ঞান অন্য কোনো উন্নত উৎস থেকে পাওয়া হতে পারে।
এনিয়াকের বিষয়ে একটি মজার গুজব ছিল যে এটি কখনো কখনো নিজে থেকে কাজ শুরু করত। প্রোগ্রামাররা জানতেন না কেন, তবে মাঝে মাঝে এটি এমন ফলাফল দিত যা প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। যদিও বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে বিদ্যুৎ বা যান্ত্রিক ত্রুটির ফল বলে ব্যাখ্যা দেন, তবুও এটি এনিয়াককে ঘিরে রহস্যময়তা বাড়িয়ে তোলে।
এনিয়াক বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য নয়, তবে এর কিছু অংশ পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। এনিয়াকের উদ্ভাবন আমাদের আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছে। এটি কম্পিউটার বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
বর্তমানে, এনিয়াকের প্রযুক্তি অতিক্রান্ত হয়ে সুপার কম্পিউটার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রবেশ করেছে। তবুও, এনিয়াকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এটি দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে প্রযুক্তি মানবজাতির জীবনকে সহজ করতে পারে এবং জটিল সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
এনিয়াক শুধুমাত্র একটি কম্পিউটার নয়, এটি ছিল প্রযুক্তির পথে এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আজকের আধুনিক যুগ পর্যন্ত কম্পিউটারের বিকাশে এনিয়াক একটি মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। আমাদের ডিজিটাল জীবনের যে শুরু, তার ভিত্তি স্থাপন করেছে এই অসাধারণ মেশিন।