সংস্কৃতি একটি জাতির আত্মার প্রতিচ্ছবি। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কর্মকাণ্ড, আচরণ, বিশ্বাস, এবং জীবনধারার সমষ্টি হচ্ছে সংস্কৃতি। এটি একদিকে যেমন প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখে, তেমনি আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়। বিশ্বের ইতিহাসে নানা সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতা আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি বা পরিবর্তন হয়। এটি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। সংস্কৃতি একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়, আবার তা বৈশ্বিক প্রভাবও ফেলতে পারে। একটি জাতি বা সমাজের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তোলে সংস্কৃতি। মানুষের আচরণ ও মূল্যবোধে সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। সংস্কৃতি সমাজের মানুষদের মাঝে সংহতি তৈরি করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অতীতের ইতিহাস এবং মূল্যবোধ সংরক্ষণ করে।
বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতি
১. মিশরীয় সভ্যতা:
মিশরীয় সভ্যতা মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ সভ্যতা। নীলনদ নদীর তীরবর্তী এই সভ্যতা প্রায় ৩,০০০ বছর ধরে বিস্তার লাভ করেছিল। তাদের সংস্কৃতি শুধু ঐ সময়ের জন্য নয়, আধুনিক বিশ্বেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
ধর্ম ও বিশ্বাস: মিশরীয় সংস্কৃতি গভীরভাবে তাদের ধর্ম ও বিশ্বাসের সাথে জড়িত ছিল। তারা বহু দেবদেবীর পূজা করত, যেমন- রা (সূর্যের দেবতা), ওসিরিস (পুনর্জন্মের দেবতা), এবং আইসিস (মাতৃত্ব ও জাদুর দেবী)। মিসরীয়দের ধারণা ছিল যে, মৃত্যুর পর জীবন শেষ হয় না, বরং আত্মা অন্য জগতে প্রবেশ করে। তাই মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য তারা মমি তৈরি করত এবং পিরামিডে সমাধিস্থ করত।
স্থাপত্য: মিশরীয় স্থাপত্যকলা তাদের সংস্কৃতির অন্যতম উজ্জ্বল দিক। গিজার মহা পিরামিড পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি এবং প্রাচীন মিসরের গৌরবময় স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। এছাড়া কার্নাক মন্দির, আবু সিম্বেল মন্দির, এবং লুক্সরের মন্দির মিসরীয় স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন।
হায়ারোগ্লিফিক লিপি: মিশরীয় সভ্যতার আরেকটি বড় অর্জন ছিল হায়ারোগ্লিফিক লিপি। এটি তাদের লিখিত ভাষা, যা ছবি ও প্রতীক ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এই লিপি তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ, ইতিহাস, এবং দৈনন্দিন জীবনের তথ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো।
শিল্প ও সঙ্গীত: মিশরীয় সংস্কৃতিতে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের মাধ্যমে দেবদেবী এবং রাজপরিবারের চিত্রায়ণ করা হতো। সঙ্গীতও ছিল তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, এবং সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে সঙ্গীত ব্যবহার করা হতো।
জীবনধারা: মিশরীয়দের দৈনন্দিন জীবনধারা ছিল কৃষিনির্ভর। নীলনদের বার্ষিক বন্যা তাদের জন্য উর্বর জমি নিয়ে আসত, যা ফসল উৎপাদনে সহায়ক ছিল। তাদের খাদ্যাভ্যাসে রুটি, মধু, এবং মাংস প্রধান ছিল। এছাড়া তারা সুতি কাপড় ব্যবহার করত এবং গয়না পরিধানে পারদর্শী ছিল।
পাণ্ডিত্য ও বিজ্ঞান: মিশরীয়রা জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে অগ্রগতি সাধন করেছিল। নীলনদের বন্যার সময় নির্ধারণ এবং পিরামিড নির্মাণে তাদের জ্যামিতির জ্ঞান ব্যবহৃত হয়। তাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর লেখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলো আজও বিস্ময়ের বিষয়।
২. গ্রিক সংস্কৃতি:
গ্রিক সংস্কৃতি মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি মৌলিক ও প্রভাবশালী অধ্যায়। প্রাচীন গ্রিসের শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, এবং রাজনৈতিক ধারণা আধুনিক বিশ্বে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এ সংস্কৃতিকে প্রাচীন সভ্যতার ভিত্তি বলা হয়।
শিল্প ও স্থাপত্য: গ্রিক সংস্কৃতিতে শিল্প ও স্থাপত্য একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে। পার্থেনন মন্দিরের মতো স্থাপত্যশৈলী প্রাচীন গ্রিসের শিল্পকলার উৎকর্ষ প্রকাশ করে। তাদের ভাস্কর্যগুলো মানবদেহের সৌন্দর্য ও গঠনশৈলীকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে।
সাহিত্য: গ্রিক সাহিত্যের মধ্যে হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘অডিসি’ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন মহাকাব্য। এছাড়া সোফোক্লিস, ইউরিপিডিস, এবং অ্যারিস্টোফেনিসের নাটকগুলি গ্রিক নাট্যকলার উচ্চতর পর্যায়ের পরিচয় বহন করে।
দর্শন: গ্রিক দর্শন আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছে। সক্রেটিস, প্লেটো, এবং অ্যারিস্টটলের দর্শন আজও সমসাময়িক চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ এবং অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’ রাজনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
বিজ্ঞান ও গণিত: গ্রিক সংস্কৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও অগ্রগামী ছিল। পিথাগোরাস, ইউক্লিড, এবং আর্কিমিডিস গণিতশাস্ত্রের বিকাশে অবদান রেখেছেন। হিপোক্রেটিসকে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলা হয়।
ক্রীড়া: প্রাচীন গ্রিসের অলিম্পিক গেমস তাদের ক্রীড়া সংস্কৃতির পরিচায়ক। ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বে শুরু হওয়া এই গেমস আধুনিক অলিম্পিক গেমসের অনুপ্রেরণা।
ধর্ম: প্রাচীন গ্রিক ধর্মে বহু দেবদেবীর পূজা করা হতো। জিউস, অ্যাথেনা, অ্যাপোলো, এবং আর্টেমিসের মতো দেবতাদের মিথসমূহ গ্রিক সংস্কৃতির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই মিথগুলো শিল্প, সাহিত্য, এবং নাটকে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
সমাজ ও রাজনীতি: গ্রিক সমাজে নাগরিকত্ব ও গণতন্ত্রের ধারণা প্রথম বিকাশ লাভ করে। এথেন্স শহর-রাষ্ট্র গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। এ ধারণা আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।
৩. রোমান সভ্যতা:
রোমান সভ্যতা মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এটি শুধু একটি সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নয়, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশেও অনন্য অবদান রেখেছে। রোমানদের স্থাপত্য, আইনব্যবস্থা, সাহিত্য, এবং সামাজিক কাঠামো আধুনিক বিশ্বের ভিত্তি গঠনে ভূমিকা রেখেছে।
স্থাপত্য ও প্রকৌশল: রোমান স্থাপত্যশৈলী তাদের সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কলোসিয়াম, প্যানথিয়ন, এবং অ্যাকোয়াডাক্টের মতো স্থাপত্য নিদর্শন আজও তাদের প্রকৌশল দক্ষতার উদাহরণ। আর্চ, ডোম, এবং সিমেন্ট ব্যবহার করে রোমানরা স্থাপত্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল।
আইনব্যবস্থা: রোমান সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান তাদের আইনব্যবস্থা। রোমান আইন আধুনিক আইনের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। ‘বারো টেবিল’ নামক আইনকানুন রোমান সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এ আইনপদ্ধতি পরবর্তীতে ইউরোপীয় এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের আইনব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলেছে।
সাহিত্য ও দর্শন: রোমান সাহিত্য ও দর্শন গ্রিক সভ্যতা থেকে প্রভাবিত হলেও তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। ভার্জিল, হোরেস, এবং ওভিডের সাহিত্যকর্ম রোমান সংস্কৃতির গৌরবময় উদাহরণ। সিসেরো এবং সেনেকার দর্শন ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা রোমান সংস্কৃতিকে গভীরতা প্রদান করেছে।
ধর্ম: প্রাচীন রোমান ধর্মে বহু দেবদেবীর পূজা করা হতো। দেবতা জুপিটার, জুনো, এবং মিনার্ভা তাদের প্যানথিয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মের বিকাশ ঘটে, যা রোমান সভ্যতার একটি নতুন দিক উন্মোচন করে।
সমাজ ও জীবনধারা: রোমান সমাজ ছিল সুসংগঠিত এবং শ্রেণিবদ্ধ। প্যাট্রিসিয়ান (উচ্চবর্ণ) এবং প্লেবিয়ান (সাধারণ জনগণ) শ্রেণি রোমান সমাজের ভিত্তি ছিল। উৎসব, থিয়েটার, এবং গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ রোমানদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: রোমান সভ্যতা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও উন্নত ছিল। রাস্তা নির্মাণ, জলব্যবস্থা, এবং সেনাবাহিনীর সরঞ্জাম উন্নয়নে তাদের দক্ষতা আধুনিক প্রযুক্তির পূর্বসূরি হিসেবে কাজ করেছে।
৪. চীনা সংস্কৃতি:
চীনা সংস্কৃতি বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতিগুলোর একটি। এই সংস্কৃতি প্রায় পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস বহন করে, যা আজও বিশ্বকে মুগ্ধ করে। কনফুসিয়ানিজম, তাওবাদ, এবং বৌদ্ধধর্ম চীনা সমাজ ও সংস্কৃতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
দর্শন ও ধর্ম: চীনা সংস্কৃতির ভিত্তি কনফুসিয়ানিজম, তাওবাদ, এবং বৌদ্ধধর্ম। কনফুসিয়ানিজম সামাজিক শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, এবং মানবিক মূল্যবোধের উপর জোর দেয়। তাওবাদ প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উপর গুরুত্বারোপ করে। বৌদ্ধধর্ম আত্মার মুক্তি এবং মানবকল্যাণের শিক্ষা দেয়।
ভাষা ও সাহিত্য: চীনা ভাষা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও জটিল ভাষা। চীনা লিপি চিত্রলিপি বা পিক্টোগ্রাফের উপর ভিত্তি করে তৈরি। চীনা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের এক মূল্যবান অংশ। লাওজি রচিত ‘তাও তে চিং’ এবং সানঝু-এর “আর্ট অব ওয়ার” চীনা জ্ঞানের এক অনন্য নিদর্শন।
শিল্প ও সংগীত: চীনা সংস্কৃতিতে চিত্রকলা, ভাস্কর্য, এবং ক্যালিগ্রাফি বিশেষ স্থান দখল করে। চীনা চিত্রকলা প্রকৃতি ও মানবজীবনের অনন্য সৌন্দর্য তুলে ধরে। সংগীত চীনা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা প্রাচীনকালে ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিল।
উৎসব: চীনা সংস্কৃতির সবচেয়ে রঙিন দিক তাদের উৎসব। চীনা নববর্ষ, চন্দ্র নববর্ষ, এবং মধ্য-শরৎ উৎসব তাদের প্রধান উৎসব। এসব উৎসবে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, সংগীত, এবং খাওয়া-দাওয়া বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
চীনা চিকিৎসাশাস্ত্র: চীনা সংস্কৃতিতে চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। প্রাচীন চীনা চিকিৎসা, যেমন আকুপাংচার এবং হার্বাল চিকিৎসা, আজও বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
স্থাপত্য: চীনা স্থাপত্যে ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য গুরুত্বপূর্ণ। গ্রেট ওয়াল অব চায়না চীনা স্থাপত্যশৈলীর এক বিস্ময়কর উদাহরণ। তাছাড়া প্যাগোডা এবং চীনা বাগান তাদের স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিকতা তুলে ধরে।
চীনা সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য: চীনা সংস্কৃতি তার ঐতিহ্যের পাশাপাশি আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছে। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, এবং শিল্পের বিকাশে চীন আজও অগ্রগামী। তবে তারা তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
৫. ভারতীয় সংস্কৃতি:
ভারতীয় সংস্কৃতি বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতিগুলোর একটি। বৈচিত্র্যময় ধর্ম, ভাষা, খাদ্য, পোশাক, এবং শিল্পকলার সমন্বয়ে গঠিত এই সংস্কৃতি প্রায় পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস বহন করে। ভারতীয় সংস্কৃতি শুধু ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সারা বিশ্বে প্রভাব ফেলেছে।
ধর্ম ও দর্শন: ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্ম ও দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, এবং শিখধর্মের জন্মভূমি এই ভারত। প্রতিটি ধর্মই নিজস্ব জীবনদর্শন ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে। এছাড়া, ভারতের দর্শনশাস্ত্র, যেমন উপনিষদ, বেদান্ত, এবং যোগ দর্শন, সারা বিশ্বের মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে।
ভাষা ও সাহিত্য: ভারতীয় ভাষার বৈচিত্র্য অসাধারণ। সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা, তামিল, উর্দু, এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাগুলো ভারতের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির প্রতীক। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, যেমন বেদ, উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ, এবং কালিদাসের সাহিত্যকর্ম, ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরতা ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
সংগীত ও নৃত্য: ভারতীয় সংগীত ও নৃত্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, যেমন হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটক সংগীত, গভীর ঐতিহ্য বহন করে। ভরতনাট্যম, কথাকলি, কুচিপুড়ি, এবং ওড়িশি নৃত্যশৈলী ভারতীয় সংস্কৃতির নান্দনিক দিক তুলে ধরে।
শিল্প ও স্থাপত্য: ভারতীয় সংস্কৃতিতে শিল্প ও স্থাপত্যের এক অনন্য সমৃদ্ধি রয়েছে। তাজমহল, অজন্তা ও ইলোরা গুহা, খাজুরাহোর মন্দির, এবং কুতুব মিনারের মতো স্থাপত্যকর্ম ভারতের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এছাড়া, মুঘল, দ্রাবিড়, এবং রাজস্থানি স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব ভারতীয় স্থাপত্যে লক্ষণীয়।
উৎসব: ভারতীয় সংস্কৃতি উৎসবমুখর। দিওয়ালি, হোলি, ঈদ, দুর্গাপূজা, ক্রিসমাস, এবং পংগলের মতো উৎসব ভারতের বহুমুখী সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি উৎসবই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উদযাপন করে।
খাদ্যসংস্কৃতি: ভারতীয় খাদ্যসংস্কৃতি তার বৈচিত্র্যের জন্য বিশ্বখ্যাত। মসলা, ভাত, রুটি, এবং বিভিন্ন প্রকার কারি ভারতীয় খাদ্যের প্রধান উপকরণ। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব বিশেষ খাদ্যরীতি রয়েছে, যেমন দক্ষিণ ভারতের ইডলি-দোসা, পাঞ্জাবের মাখনমাখা পরোটা, এবং বাংলার রসগোল্লা।
যোগ ও আয়ুর্বেদ: ভারতীয় সংস্কৃতিতে যোগ ও আয়ুর্বেদের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। যোগ শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার একটি প্রাচীন পদ্ধতি। আয়ুর্বেদ, প্রাচীন চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রাকৃতিক উপাদানের মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের উপর গুরুত্ব দেয়।
৬. বাংলা সংস্কৃতি
বাংলা সংস্কৃতি একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি, যা ইতিহাস, সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্যের মেলবন্ধন। এটি শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; পশ্চিমবঙ্গসহ সারা বিশ্বে বাঙালিদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভাষা ও সাহিত্য: বাংলা সংস্কৃতির ভিত্তি হলো বাংলা ভাষা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষায় এক অনন্য উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। বাঙালি সাহিত্যে ‘গীতাঞ্জলি’, ‘বিদ্রোহী’, এবং ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ চিরস্মরণীয়।
সংগীত ও নৃত্য: বাংলা সংগীত এবং নৃত্যশৈলী বৈচিত্র্যময়। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, লোকসঙ্গীত, ভাটিয়ালি, এবং জারি-সারি গান বাংলার সংগীত ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ। নৃত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনৃত্য এবং লোকনৃত্য বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
উৎসব: বাংলা সংস্কৃতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার উৎসব। পহেলা বৈশাখ, দুর্গাপূজা, ঈদ, এবং নবান্ন উৎসব বাঙালির ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই উৎসবগুলিতে ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।
শিল্প ও স্থাপত্য: বাংলার শিল্প ও স্থাপত্য তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন। সোনারগাঁও, ষাটগম্বুজ মসজিদ, এবং পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বাংলার স্থাপত্যকলার নিদর্শন। এছাড়া পটচিত্র এবং নকশিকাঁথা বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার অন্তর্ভুক্ত।
খাদ্যসংস্কৃতি: বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো তার খাদ্য। ভাত, মাছ, শুক্তো, পায়েস, এবং রসগোল্লা বাঙালি খাদ্যের অনন্য উদাহরণ। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব স্বাদ এবং বৈশিষ্ট্য খাদ্যসংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা: বাংলা সংস্কৃতি ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় পরিচয় এবং সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছে।
বর্তমান বৈশ্বিকায়নের যুগে সংস্কৃতি নতুন নতুন মাত্রা অর্জন করছে। প্রযুক্তি এবং আন্তঃসংস্কৃতি বিনিময়ের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। তবে, স্থানীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতি কেবল অতীতের গৌরবগাথা নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি। সুতরাং, বিশ্ব সংস্কৃতির এই বৈচিত্র্যকে সম্মান জানিয়ে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।