বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০২৫

লোকতা: নেপালের টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব কাগজ

লোকতা
লোকতা পেপার (Lokta Paper) একধরনের হস্তনির্মিত প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব কাগজ, যা প্রধানত নেপালে তৈরি হয়। বিশ্বব্যাপী এটি নেপালি কাগজ (Nepali Kagaz) নামেও পরিচিত। এটি লোকতা গাছ (Daphne bholua বা Daphne papyracea) থেকে সংগৃহীত আঁশযুক্ত বাকল থেকে প্রস্তুত করা হয়। সনাতন পদ্ধতিতে বানানো এই কাগজটি পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই। লোকতা গাছ আকারে ছোট, কাটার পর গাছটি দ্রুতই পুনরায় গজে ওঠে। এতেকরে কাগজ বানাতে লোকটা গাছ কাটার ফলে পরিবেশের উপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। বহুমুখী ব্যবহার ও এর শৈল্পিক মূল্যবোধের জন্য লোকতা পেপার বেশ জনপ্রিয়।

লোকতা পেপারের ইতিহাস
লোকতা পেপারে ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় পবিত্র পাঠ লেখা হতো। লোকতা পেপারে লেখা তথ্যাদি সহস্রাব্দ ধরে টিকে থাকতে পারে (২০০০-৩০০০ বছর)। নেপালে প্রাপ্ত প্রাচীনতম লোকতা পেপার হলো ‘করন্য বুহা সূত্র’ ‘Karanya Buha Sutra’ (পবিত্র বুদ্ধের বাণী)। এটি নেপালের জাতীয় আর্কাইভ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।

১৯৫০-এর দশকে ভারত থেকে সস্তা যন্ত্রনির্মিত কাগজ আমদানির ফলে লোকতা পেপারের ব্যবহার কমে যায়। তবে, বিদেশে এই ঐতিহ্যবাহী কাগজের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এটি আবার জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

লোকতা পেপার তৈরির প্রক্রিয়া

লোকতা পেপার তৈরি একটি প্রথাগত সনাতনী প্রক্রিয়া। এই কাগজ প্রস্তুত করতে বড় কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। গাছের বাকল সংগ্রহ, সেদ্ধ করা, গালিয়ে মসৃণ পেস্ট তৈরি করা, ফ্রেমে কাগজের আকার দেওয়া এবং রোদে শুকানোর প্রক্রিয়ার প্রায় পুরোটাই করা হয় মেশিনের সাহায্য ব্যতীত। কিছু আঞ্চলে অবশ্য বাকল গালিয়ে মসৃণ করার ক্ষেত্রে মটরচালিত ছোট মেশিনের ব্যবহার দেখা যায়। তবে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিষে সেদ্ধ করা বাকলকে পেস্টে রূপ দেয়া লোকতা পেপার প্রস্তুতের ঐতিহ্যগত ধাপ।

লোকতা গাছ (Lokta Plant) কী?
লোকতা নেপালের স্থানীয় গাছ এবং একটি পরিবেশগত বিস্ময়। লোকতা গাছ নিজে থেকেই পুনরুজ্জীবিত হয় এবং কাটার ৪-৫ বছরের মধ্যে পরিপক্ক হয়। তাই এটি বনজ পরিবেশে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না।

লোকতা সংগ্রহ
লোকতা গাছের ডাঁটা মাটি থেকে প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার ওপরে কেটে ফেলা হয়। তবে শেকড় নষ্ট হয় না। সময়মতো না কাটলে গাছ শুকিয়ে যেতে শুরু করে। লোকতা গাছ সাধারণত হিমালয়ের ৬৫০০ থেকে ৯৫০০ ফুট উচ্চতার স্যাঁতসেঁতে অঞ্চলে জন্মে। গাছটি কাটার পর এর বাকল ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এই বাকলই লোকতা পেপারের মূল কাঁচামাল। লোকতা গাছের পাশাপাশি অরগেলি নামের একটি লোকতা প্রজাতির গাছের ছালও ব্যবহৃত হয় কাগজের কাঁচামাল হিসেবে। অরগেলি গাছের (Argeli Plant) বাকলও নেপালের হিমালয় অঞ্চল থেকেই সংগ্রহ করা হয়। কিছু কিছু অঞ্চলে লোকতা গাছের বাকলের সাথে বাবিও ছন (Babiyo Grass) এর মিশ্রণ করা হয় লোকতা পেপার প্রস্তুতে। বাবিও ছন ব্যবহারে লোকতা পেপার আরো টেকসই রূপ ধারণ করে।

বাকল সংরক্ষণ
গাছ থেকে বাকল ছাড়ানোর পর ভিতরের আঁশযুক্ত সাদা অংশ পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করা হয়। দা কিংবা ছুরি দিয়ে বাকলের দু’পাশের অপ্রয়োজনীয় অংশ ছাড়ানো হয়। এরপর আঁশযুক্ত সাদা অংশ পরিস্কার স্থানে সংগ্রহ করা হয়।

কারখানায় প্রেরণ
হিমালয় অঞ্চল থেকে সংগৃহীত লোকতা গাছের বাকল নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। ওজনের মাধ্যমে এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়। হিমালয় থেকে এই কাগজের মূল উপাদান সংগ্রহ করা হলেও পুরো নেপালজুড়ে লোকতা পেপারের কারখানা রয়েছে।

সেদ্ধ করা
পরিষ্কার কাঁচামালগুলো সনাতন পদ্ধতিতে চুলায় সেদ্ধ করা হয়। চুলায় সেদ্ধ করার সময় কোথাও কোথাও বেনজিন ও কস্টিক সোডা ব্যবহার করা হয়, যা কাঁচামাল দ্রুত গালাতে সাহায্য করে। বিশেষভাবে তৈরি এই চুলার জ্বালানি গাছের গুড়ি। কারখানার আশেপাশে স্তুপ করে রাখা হয় জ্বালানির জন্য সংগ্রহ করা গাছের খণ্ডগুলোকে। এরপর কুড়াল দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে চুলায় দেয়া হয়। ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় ধরে তীব্র তাপে কাঁচামাল সেদ্ধ হয়।

পানিতে ভেজানো
সেদ্ধ হওয়া কাঁচামাল চুলা থেকে নামিয়ে পাশের কোনো টাংকি বা গামলায় ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে রাখা হয়। কয়েকবার পানি পরিবর্তন করে সেদ্ধ কাঁচামাল পরিষ্কার ও ঠান্ডা করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা পর সেদ্ধ কাঁচামালকে চিবিয়ে পানি ছাড়িয়ে পাল্পিং মেশিনে কিংবা কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিষে মসৃণ পেস্ট বা মণ্ডে রূপান্তর করা হয়। মটরচালিত পাল্পিং মেশিনে কাঁচামাল পিষানোর সময় পানি মেশানো হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে ছেঁকে পানি থেকে মণ্ড আলাদা করে নেয়া হয় এবং ২০ মিনিট পানি ঝরার জন্য রেখে দেয়া হয়। এই পর্যায়ে কাগজের মূল উপাদান প্রস্তুত, পরবর্তি ধাপে এই মণ্ডকে কাগজে রূপ দেয়া হবে।

ফ্রেমে ছড়িয়ে রোদে শুকানো
দিনের শুরুতে কাঠের চৌবাচ্চা এবং অন্যান্য সামগ্রী ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। এরপর কাঠের চৌবাচ্চা পরিষ্কার পানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। মণ্ড পাতলা করার জন্য আরেকটি পাত্রে পানি ভরা হয়। এরপর নির্দিষ্ট পরিমান মণ্ড এনে ঢালা হয় ড্রাম ভর্তি পানিতে। কাঠির সাহায্যে পানি ও মণ্ড ভালোভাবে মিশিয়ে প্রস্তুত করা হয় তরল মণ্ড। এরপর একটি ছোট বাটি দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমান তরল মণ্ড ঢালা হয় কাঠের চৌবাচ্চায়। হাত দিয়ে নেড়ে চৌবাচ্চার পানিতে তরল মণ্ড ভালোভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর মিহি সুতার ছাঁকনি সম্বলিত কাঠের চারকোণা ফ্রেম চৌবাচ্চার পানিতে চুবিয়ে মিশে থাকা মণ্ডকে ছেঁকে তোলা হয়। এতে করে চৌবাচ্চার পানিতে মিশে থাকা তরল মণ্ড কাঠের চারকোনা ফ্রেম বা ফরমায় থাকা সুতার ছাঁকনিতে জমে যায়, আর পানি ঝরে পড়ে কাঠের চৌবাচ্চায়। এরপর ফরমা বা ফ্রেমটিকে পানি ছাড়ানোর জন্য কিছুক্ষণ পাশেই কোনো মাচায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পানি ঝরে গেলে ফ্রেমগুলোকে খুঁটির সাথে সূর্যের মুখোমুখিভাবে দাঁড় করানো হয়। সূর্যের তাপে ৩০ মিনিট সময়ের মধ্যে মণ্ড শুকিয়ে কাগজে পরিণত হয়। সূর্যের আলোর তীব্রতা কম থাকলে কাগজ শুকাতে সময় ব্যয় হতে পারে ২ ঘণ্টা পর্যন্ত।

কাগজ সংগ্রহ
সূর্যের আলোর পানি শুকিয়ে কাগজ প্রস্তুত হয়ে গেলে ফ্রেম থেকে কাগজগুলোকে ছাড়ানো হয়। ফ্রেমের উপরের অংশ থেকে কাগজটি ছাড়িয়ে টান দিলে পুরো কাগজটি হাতে চলে আসে। একে একে সবগুলো কাগজ ছাড়ানো হয়ে গেলে ফ্রেমগুলোকে কাঠের চৌবাচ্চার কাছে নিয়ে আসা হয় পুনরায় ব্যবহার করার জন্য। সংগৃহীত কাগজগুলোকে উপযুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়। নির্দিষ্ট পরিমান কাগজ জমা হলে ব্যবসায়ী এসে প্রতি পিস দরে কিনে নিয়ে যায়।

লোকতা পেপারের ব্যবহার
নেপালের সরকারি রেকর্ড সংরক্ষণের জন্য লোকতা পেপার ব্যবহৃত হয়। এটি আর্দ্রতা, ছিঁড়ে যাওয়া, পোকামাকড় এবং ছত্রাক প্রতিরোধী। প্রথাগতভাবে ধর্মীয় গ্রন্থে লোকতা পেপারের ব্যবহার রয়েছে। ওয়ালপেপার, রেস্টুরেন্ট মেনু, মোড়ক, ক্যালেন্ডার, গিফট বক্স, অ্যালবাম, গ্রিটিং কার্ড, আর্ট পেপার এবং বই বাঁধাইয়ের কাজেও লোকতা পেপার ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, লোকতা পেপার আধুনিক আর্টস এবং ক্রাফটস, অরিগামি, আমন্ত্রণপত্র, ভিজিটিং কার্ড, এবং ফ্যাশন অ্যাক্সেসরিজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

লোকতা পেপারের বৈশিষ্ট্য
লোকতা পেপার খুবই টেকসই এবং সহজে ছিঁড়ে যায় না। ফলে সময়ের সাথে এ কাগজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। এই কাগজের একটি অনন্য গঠন ও টেক্সচার রয়েছে। তাছাড়া এই কাগজ জলরোধী। পোকামাকড়, যেমন সিলভারফিশ এবং উইপোকা প্রতিরোধী হওয়ায় এ কাগজ অন্য কাগজের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী। লোকতা পেপার কলম বা প্রিন্টের কালি সুন্দরভাবে ধরে রাখে।

লোকতা পেপার একটি পরিবেশবান্ধব পণ্য। লোকতা গাছের ছাল সংগ্রহের সময় গাছটি ধ্বংস করা হয় না, বরং এটি স্বাভাবিকভাবেই পুনরায় বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এই কাগজ পরিবেশ দূষণ করে না এবং সহজেই প্রাকৃতিকভাবে মাটিতে মিশে যায়।

অর্থনৈতিক প্রভাব
লোকতা শিল্প নেপালের গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। বর্তমানে নেপালে প্রায় হাজারের কাছাকছি হস্তনির্মিত কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা প্রতিবছর প্রায় ৩০,০০০ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদন করে।

উপসংহার
অতীতের ঐতিহ্যবাহী লোকতা পেপার এখন আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর শক্তি, স্থায়িত্ব ও পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্যের জন্য এটি স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় বাজারেই চাহিদাসম্পন্ন।

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Email
ফারাও
ইতিহাস

ফারাও: প্রাচীন মিশরের রাজাদের ইতিহাস

ফারাও শব্দটি মিশরীয় শব্দ ‘পের-আ’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ “মহান ঘর”। এটি মূলত রাজকীয় প্রাসাদের প্রতি ইঙ্গিত করে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মিশরের শাসকদের উপাধি

Read More »
হুন জাতি
মানবসভ্যতা

হুন জাতি: ইতিহাস, সভ্যতা ও প্রভাব

হুন জাতি (Huns) প্রাচীন ইউরেশীয় স্টেপ অঞ্চলের একটি শক্তিশালী এবং ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্র জনগণ, যারা ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে ব্যাপকভাবে পরিচিত

Read More »
আইরিশদের মিশ্র খেলা
সংস্কৃতি

আইরিশদের মিশ্র খেলা: ঐতিহ্য, কৌশল এবং সমাজিক বন্ধন

আইরিশদের মিশ্র খেলা (Irish mixed game) এমন একটি খেলা যা আইরিশ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই খেলা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সমাজের মধ্যে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

Read More »
উমোজা গ্রাম
মানবসভ্যতা

উমোজা গ্রাম: নারীর নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতীক

উমোজা গ্রাম পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ার সাম্বুরু এলাকায় অবস্থিত। এটি কেবল একটি গ্রাম নয়, বরং নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতীক। পুরুষশাসিত সমাজের শোষণ ও নিপীড়নের শিকার

Read More »
হুলি উইগমেন
মানবসভ্যতা

হুলি উইগমেন: পাপুয়া নিউ গিনির বাহারিমানব

হুলি উইগমেন (Huli Wigmen) পাপুয়া নিউ গিনির একটি ঐতিহ্যবাহী উপজাতি গোষ্ঠী, যারা দক্ষিণ-পশ্চিম পাপুয়া নিউ গিনির হুলি জাতির অংশ। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা বিশেষত তাদের উজ্জ্বল

Read More »
ডলগান জাতি
মানবসভ্যতা

ডলগান জাতি: সাইবেরিয়ার আর্কটিক অঞ্চলের ঐতিহ্য ও জীবনধারা

ডলগান (Dolgan) জাতি সাইবেরিয়ার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের এক বিশেষ আদিবাসী গোষ্ঠী, যারা মূলত সাইবেরিয়ার আর্কটিক অঞ্চলের তুনগুসকা নদী, ইয়েনিসি নদী এবং সাইবেরিয়ার অন্যান্য শীতল অঞ্চলে বাস

Read More »
পেনান গোত্র
মানবসভ্যতা

পেনান গোত্র: বোর্নিও দ্বীপের আদিবাসী জীবনের এক অনন্য চিত্র

পেনান গোত্র (Penan Tribe) মালয়েশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি আদিবাসী গোত্র। এই গোত্রের পরিচয় মূলত তাদের শিকারী জীবিকা, বনজ সম্পদে নির্ভরশীলতা

Read More »