সুমেরু অঞ্চল বা আর্কটিক (Arctic) পৃথিবীর উত্তর মেরুর বিস্তীর্ণ বরফাচ্ছাদিত এলাকা। এটি বিশ্বের অন্যতম শীতলতম ও রহস্যময় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। সুমেরুর বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং এখানকার জীবজন্তু ও মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে জানার কৌতূহল সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
সুমেরু অঞ্চল মূলত আর্কটিক মহাসাগর এবং তার আশপাশের কিছু দেশ, যেমন কানাডা, রাশিয়া, গ্রিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (আলাস্কা) উত্তরাংশ নিয়ে গঠিত। এই অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বছরের বেশিরভাগ সময়ই তুষারাবৃত থাকা এবং চরম ঠাণ্ডা আবহাওয়া।
সুমেরুতে গ্রীষ্মকালীন সময়ে ২৪ ঘণ্টাই সূর্য দেখা যায়, যাকে ‘মধ্যরাতের সূর্য’ বলা হয়। আবার শীতকালে দীর্ঘ সময় ধরে অন্ধকার বিরাজ করে, যাকে বলে ‘মেরু রাত্রি’। শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যেতে পারে, এবং গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ০ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকতে পারে।
এই শীতল অঞ্চলেও প্রকৃতি এক অনন্য জীববৈচিত্র্যের সম্ভার গড়ে তুলেছে। সুমেরু অঞ্চলের সবচেয়ে পরিচিত প্রাণী হলো মেরু ভাল্লুক (Polar Bear), যা বরফের উপর বাস করে এবং প্রধানত সিল মাছ শিকার করে বেঁচে থাকে। এছাড়াও এখানে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী পাওয়া যায়, যেমন আর্কটিক শিয়াল, সুমেরু হরিণ (Caribou), সিল মাছ, ওয়ালরাস, তিমি এবং বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক পাখি।
সুমেরু অঞ্চলে বসবাসকারী প্রধান জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ইনুইত (Inuit), সামি (Sámi) এবং ইউপিক (Yupik) অন্যতম।
ইনুইত: ইনুইত জনগোষ্ঠী মূলত কানাডা, গ্রিনল্যান্ড এবং আলাস্কার উত্তরাঞ্চলে বসবাস করে। তারা বরফের মধ্যে বসবাসের উপযোগী ইগলু তৈরি করে এবং প্রধানত শিকার ও মাছ ধরার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে।
সামি: সামি জনগোষ্ঠী মূলত নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়ার কিছু অংশে বসবাস করে। তারা প্রধানত হরিণ পালন করে এবং ঐতিহ্যবাহী সংগীত, পোশাক ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ।
ইউপিক: ইউপিক জনগোষ্ঠী আলাস্কা এবং রাশিয়ার কিছু অংশে বসবাস করে। তারা সমুদ্র উপকূলে বসবাস করে এবং প্রধানত মাছ ধরা, সীল শিকার ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ইনুইতদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুমেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান প্রমাণ। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, বরফ গলার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে, যা বিশ্বের নিম্নভূমি অঞ্চলের জন্য বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, এখানকার জীববৈচিত্র্যের ওপরও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
বিভিন্ন দেশ সুমেরু অঞ্চলে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য এবং ভূতত্ত্ব সংক্রান্ত বিষয়ে। আর্কটিক গবেষণা কেন্দ্রগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য পরিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
সুমেরু অঞ্চল তার শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্য, রহস্যময় প্রকৃতি এবং বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের কারণে আমাদের বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাতে এই বিস্ময়কর অঞ্চল ভবিষ্যতেও তার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারে।