গিরগিটি হল সরীসৃপ শ্রেণির একটি আকর্ষণীয় প্রাণী, যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। এদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে কিছু অসাধারণ রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতা, শিকার ধরার অভিনব কৌশল এবং বিচিত্র আকারের জন্য বিখ্যাত। চলুন জেনে নিই বিশ্বের শীর্ষ ১০ গিরগিটি সম্পর্কে।
১. প্যান্থার গিরগিটি (Panther Chameleon)
প্যান্থার গিরগিটি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর ও আকর্ষণীয় গিরগিটি, যা প্রধানত মাদাগাস্কারের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে পাওয়া যায়। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Furcifer pardalis। প্যান্থার গিরগিটির সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল এদের রঙ পরিবর্তনের অসাধারণ ক্ষমতা। এরা পরিবেশ, তাপমাত্রা, মনের অবস্থা এবং অন্যান্য গিরগিটির সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে লাল, সবুজ, নীল, হলুদ, কমলা এবং এমনকি বেগুনি রঙও ধারণ করতে পারে।
এরা আকারে মাঝারি থেকে বড় হয়ে থাকে, এবং পুরুষ প্যান্থার গিরগিটি প্রায় ১৭-২০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে, যেখানে মাদারা (মেয়ে) সাধারণত ছোট হয়। এদের শরীর লম্বাটে ও চওড়া এবং চোখ দুটি আলাদা আলাদাভাবে ঘোরানো যায়, যা শিকারের দিকে নজর রাখার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকর।
প্যান্থার গিরগিটি একাকী জীবনযাপন করে এবং সাধারণত গাছের ডালে বসবাস করে। এরা দীর্ঘ ও আঠালো জিহ্বা ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের কীটপতঙ্গ, ছোট মাকড়সা এবং কখনো কখনো ছোট সরীসৃপ শিকার করে।
প্যান্থার গিরগিটির প্রজনন ঋতুতে পুরুষরা উজ্জ্বল রঙ ধারণ করে এবং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। স্ত্রী গিরগিটি প্রতি ক্লাচে (একবারে) ১০-৪০টি ডিম পাড়ে, যা মাটির নিচে প্রায় ৬-১২ মাস পর্যন্ত থাকে। এদের গড় আয়ু ৩-৫ বছর হলেও সঠিক পরিচর্যা পেলে ৭ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
যদিও প্যান্থার গিরগিটির সংখ্যা এখনও স্থিতিশীল, তবে বন উজাড়, আবাসস্থলের ধ্বংস এবং পোষা প্রাণী হিসেবে অতিরিক্ত সংগ্রহের কারণে এদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়তে পারে। প্যান্থার গিরগিটি প্রকৃতির এক রঙিন বিস্ময়, যা আমাদের জীববৈচিত্র্যের সৌন্দর্য ও গুরুত্বের প্রতিচ্ছবি। এদের সংরক্ষণ করা হলে ভবিষ্যত প্রজন্মও এই অপূর্ব প্রাণীটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে।
২. জ্যাকসন গিরগিটি (Jackson’s Chameleon)
জ্যাকসন গিরগিটি (Trioceros jacksonii) হল এক বিশেষ ধরনের গিরগিটি, যা প্রধানত পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়া ও তানজানিয়ার উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে পাওয়া যায়। এরা তাদের মাথার ওপর থাকা তিনটি শিংয়ের জন্য বিখ্যাত, যা এদের গন্ডার বা ডাইনোসরের মতো চেহারা দেয়।
জ্যাকসন গিরগিটির সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল পুরুষদের মাথায় থাকা তিনটি শিং—একটি নাকের ওপরে এবং দুটি চোখের ওপরে। এই শিংগুলো মূলত প্রতিযোগিতার সময় প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো বা আক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়। স্ত্রী গিরগিটিদের শিং সাধারণত থাকে না বা খুব ছোট হয়। এদের গায়ের রঙ সবুজ, তবে পরিবেশ ও আবেগের ওপর ভিত্তি করে এটি হলুদ বা নীলাভ হতে পারে।
এরা সাধারণত ১০-১৫ ইঞ্চি (২৫-৩৮ সেমি) পর্যন্ত লম্বা হয়। পোষা অবস্থায় এরা প্রায় ৫-১০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। জ্যাকসন গিরগিটি মূলত একাকী ও ধীরগতির প্রাণী। এরা দীর্ঘ ও আঠালো জিহ্বা ব্যবহার করে কীটপতঙ্গ, ছোট মাকড়সা, ঘাসফড়িং এবং অন্যান্য ছোট প্রাণী শিকার করে। এদের চোখ দুটি আলাদাভাবে ঘোরানোর ক্ষমতা রাখে, যা ৩৬০-ডিগ্রি দৃষ্টিশক্তি প্রদান করে এবং শিকার শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
অন্যান্য বেশিরভাগ গিরগিটির মতো ডিম পাড়ার পরিবর্তে জ্যাকসন গিরগিটি সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে (Ovoviviparous)। প্রতি জন্মে ৮-৩০টি বাচ্চা জন্ম নিতে পারে, যা মায়ের দেহের ভেতরেই ডিম থেকে ফোটে।
এই গিরগিটি বর্তমানে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে নেই, তবে বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অবৈধভাবে পোষা প্রাণী হিসেবে সংগ্রহের কারণে এদের সংখ্যা কমতে পারে। জ্যাকসন গিরগিটি প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি, যার শিং এবং রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতা একে অন্যান্য গিরগিটি থেকে আলাদা করে তোলে। এদের সংরক্ষণ করা হলে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মও এই চমকপ্রদ প্রাণীটিকে দেখতে পাবে।
৩. কমডো ড্রাগন (Komodo Dragon)
কমোডো ড্রাগন (Varanus komodoensis) বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী গিরগিটি বা টিকটিকি প্রজাতির প্রাণী। এটি মূলত ইন্দোনেশিয়ার কমোডো, রিনকা, ফ্লোরেস, গিলি মোটাং এবং গিলি দাসামি দ্বীপে পাওয়া যায়। বিশাল আকার, শিকার ধরার ভয়ংকর ক্ষমতা এবং বিষাক্ত লালার জন্য এটি প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি।
কমোডো ড্রাগন দৈর্ঘ্যে প্রায় ১০ ফুট (৩ মিটার) পর্যন্ত হতে পারে এবং এদের ওজন ৭০-৯০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এদের ত্বক মোটা ও শক্ত এবং ধূসর-বাদামি রঙের হয়। শক্তিশালী পা, ধারালো নখ, এবং দীর্ঘ লেজ এদের আত্মরক্ষার অন্যতম অস্ত্র।
এরা মূলত মাংসাশী এবং মৃত প্রাণী থেকে শুরু করে হরিণ, শুকর, বানর, ছোট সরীসৃপ এবং এমনকি নিজের প্রজাতির অন্যান্য সদস্যও খেয়ে ফেলতে পারে। এদের লালা বিষাক্ত এবং এতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও বিষাক্ত প্রোটিন থাকে, যা শিকারের শরীরে প্রবেশ করলে তা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
কমোডো ড্রাগন শিকার ধরার জন্য ওত পেতে অপেক্ষা করে এবং সঠিক সুযোগ পেলেই দ্রুত আক্রমণ করে। একবার কামড় দিলে এরা শিকারের পিছু নেয় এবং কয়েক ঘণ্টা বা দিনের মধ্যে শিকার মৃত্যুবরণ করলে তা খেয়ে ফেলে। মেয়ে কমোডো ড্রাগন প্রতি প্রজনন ঋতুতে ১৫-৩০টি ডিম পাড়ে, যা মাটির নিচে বা গর্তে রাখা হয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রায় ৮ মাস লাগে। একটি কমোডো ড্রাগন সাধারণত ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
কমোডো ড্রাগন বর্তমানে ‘প্রবণ’ (Vulnerable) প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত, কারণ বন উজাড়, আবাসস্থল ধ্বংস এবং শিকারিদের দ্বারা এর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার সরকার এবং সংরক্ষণ সংস্থাগুলো এদের রক্ষা করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। কমোডো ড্রাগন প্রকৃতির এক ভয়ংকর এবং চমকপ্রদ সৃষ্টি, যা পৃথিবীর বৃহত্তম টিকটিকি প্রজাতি হিসেবে পরিচিত। এটি আমাদের বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এদের সংরক্ষণ করা ভবিষ্যৎ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. ব্রোকেসিয়া গিরগিটি (Brookesia Chameleon)
ব্রোকেসিয়া গিরগিটি (Brookesia) হল বিশ্বের সবচেয়ে ছোট গিরগিটি প্রজাতির একটি, যা মূলত মাদাগাস্কারের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে পাওয়া যায়। এদের ছোট আকৃতি, মাটির সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এবং ধীরগতির চলাফেরার জন্য এরা অত্যন্ত আকর্ষণীয় সরীসৃপ।
ব্রোকেসিয়া গিরগিটির বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে, তবে এর মধ্যে Brookesia micra সবচেয়ে ছোট, যার দৈর্ঘ্য মাত্র ২.৯ সেন্টিমিটার (১.১ ইঞ্চি)। এটি আকারে এতই ছোট যে একটি মানুষের আঙুলের ডগায় অনায়াসে বসতে পারে। এদের দেহ সাধারণত বাদামি বা সবুজাভ রঙের হয়, যা মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত।
এই ক্ষুদ্র গিরগিটি সাধারণত পাতা ও গাছের নিচের স্তরে বসবাস করে এবং খুব ধীরগতিতে চলাফেরা করে। এরা ছোট ছোট পোকামাকড়, উইপোকা এবং ক্ষুদ্র মাকড়সা শিকার করে। অন্যান্য বড় গিরগিটির মতো এদের জিহ্বাও শিকারের দিকে দ্রুত ছুড়ে দেওয়া হয়, যা শিকার ধরতে সহায়ক।
ব্রোকেসিয়া গিরগিটি বছরে একবার ডিম পাড়ে এবং প্রতিবারে ১-৫টি ডিম দেয়। ডিমগুলো মাটির নিচে বা পাতা দিয়ে আচ্ছাদিত স্থানে রাখা হয় এবং কয়েক মাস পর ফুটে বাচ্চা বের হয়। এদের গড় আয়ু ১-৩ বছর পর্যন্ত হতে পারে।
ব্রোকেসিয়া গিরগিটির বেশিরভাগ প্রজাতি শুধুমাত্র মাদাগাস্কারের নির্দিষ্ট এলাকায় পাওয়া যায়, যা বন উজাড়ের কারণে হুমকির মুখে পড়ছে। এদের সংরক্ষণ করতে বিশেষ সংরক্ষণ এলাকা তৈরি করা হয়েছে, যাতে এদের প্রাকৃতিক আবাস রক্ষা করা যায়।
ব্রোকেসিয়া গিরগিটি প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, যা বিশ্বের ক্ষুদ্রতম গিরগিটি হিসেবে পরিচিত। এর আকার ছোট হলেও এটি বাস্তুতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের সংরক্ষণ প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে।
৫. থর্নি ডেভিল (Thorny Devil)
থর্নি ডেভিল (Moloch horridus) হল অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে বসবাসকারী একটি অনন্য গিরগিটি, যা তার শরীরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কাঁটার জন্য বিখ্যাত। এই ছোট কিন্তু ভয়ংকর দেখানো প্রাণীটি শিকারিদের হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে বিশেষভাবে অভিযোজিত।
থর্নি ডেভিলের শরীর ছোট এবং কাঁটাযুক্ত, যা একে ভয়ংকর চেহারা দেয়। সাধারণত এরা ১৫-২০ সেন্টিমিটার (৬-৮ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয় এবং ওজন ৭০-৯৫ গ্রাম হয়ে থাকে। এদের ত্বকের রঙ হলুদ, বাদামি এবং ধূসর মিশ্রিত হয়, যা মরুভূমির পরিবেশের সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে সাহায্য করে।
থর্নি ডেভিলের শরীরে থাকা কাঁটা শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর। এছাড়া, এর ঘাড়ের পিছনে একটি মিথ্যা মাথার মতো অংশ থাকে, যা শিকারিদের বিভ্রান্ত করতে সাহায্য করে। যখন এটি আক্রমণের মুখে পড়ে, তখন এটি মাথা নিচু করে এই মিথ্যা মাথাটি সামনে রাখে, যাতে শিকারি বিভ্রান্ত হয়।
থর্নি ডেভিল মূলত পিঁপড়াভুক প্রাণী। এটি প্রতিদিন হাজার হাজার পিঁপড়া খেয়ে ফেলে। এদের জিহ্বা লম্বা এবং আঠালো, যা সহজেই ছোট পোকামাকড় ধরতে পারে। এই গিরগিটি ত্বকের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করার এক বিস্ময়কর ক্ষমতা রাখে। মরুভূমির শিশির বা বৃষ্টির ফোঁটা শরীরের কাঁটাযুক্ত অংশের মাধ্যমে মুখ পর্যন্ত পৌঁছায়, যা পানির অভাব পূরণে সাহায্য করে।
প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী থর্নি ডেভিল ৩-১০টি ডিম পাড়ে, যা মাটির নিচে রাখা হয় এবং প্রায় ৩-৪ মাস পর ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। এদের গড় আয়ু ১০-২০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। থর্নি ডেভিল সাধারণত মানুষের কারণে সরাসরি বিপদে নেই, তবে আবাসস্থলের পরিবর্তন ও খাদ্য সংকটের কারণে কিছু অঞ্চলে এদের সংখ্যা কমতে পারে।
থর্নি ডেভিল প্রকৃতির এক চমকপ্রদ সৃষ্টি, যা মরুভূমির কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত। এর কাঁটাযুক্ত শরীর, শিকার ধরার কৌশল এবং পানি সংগ্রহের অনন্য ক্ষমতা একে বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর সরীসৃপ বানিয়েছে।
৬. মোলাচ গিরগিটি (Moloch Lizard)
মোলাচ গিরগিটি (Moloch horridus), যা ‘ডেভিল লিজার্ড’ বা ‘ডিভিলস লিজার্ড’ নামে পরিচিত, হল অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক এবং মরুভূমি অঞ্চলের একটি বিশেষ এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় সরীসৃপ। এর চেহারা এবং আচার-আচরণ একেবারে অন্যরকম, যা প্রাকৃতিক বিশ্বের মধ্যে এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
মোলাচ গিরগিটির শরীর শক্ত এবং পুরু, যা বিশেষভাবে কাঁটাযুক্ত, যার ফলে এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক “আর্মার” বা শেল তৈরি করে। এর দেহের রঙ সাধারণত বাদামী, ধূসর বা সোনালি হয়, যা মরুভূমির মাটির সঙ্গে মিলে যেতে সহায়ক। এটির মাথা ও পিঠে বড় বড় কাঁটা থাকে, যা শিকারিদের কাছে ভয়াবহ দেখতে হয়। এর দৈর্ঘ্য সাধারণত ২০-৩০ সেন্টিমিটার (৮-১২ ইঞ্চি) হয় এবং এটি ৫০-১০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হতে পারে।
মোলাচ গিরগিটি এক ধীর গতির প্রাণী এবং এটি মরুভূমির তাপমাত্রায় বেশি সক্রিয় থাকে। এটি শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি দুর্দান্ত কৌশল অবলম্বন করে: এটি তার শরীরের কাঁটাযুক্ত অংশগুলো প্রসারিত করে এবং প্রয়োজনে গর্তে চলে যেতে পারে। এটি আক্রমণের সময় একেবারে স্থির হয়ে থাকে এবং এর রঙ পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে যায়, যাতে শিকারির চোখে না পড়ে।
মোলাচ গিরগিটি প্রধানত পোকামাকড়, বিশেষত পিঁপড়া খেয়ে থাকে। এটি পিঁপড়ের উপর নির্ভরশীল এবং খুবই ধীরগতিতে শিকার করে। এই গিরগিটি তার লম্বা, আঠালো জিহ্বা ব্যবহার করে পিঁপড়া এবং অন্যান্য ছোট পোকামাকড় শিকার করে।
এটি মরুভূমির তাপমাত্রায় বাস করার জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত। মোলাচ গিরগিটি পানি সংগ্রহের জন্য অদ্ভুত একটি কৌশল ব্যবহার করে: এটি শারীরিকভাবে মাটি বা শুষ্ক গাছপালার মধ্যে বসে, এবং শুষ্ক আবহাওয়া থেকে শিশির বা বৃষ্টির পানিকে নিজের শরীরে শোষণ করে।
মোলাচ গিরগিটি সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক অঞ্চলগুলিতে দেখা যায় এবং এটি বন্য পরিবেশে বেশি হুমকির মুখে নেই, তবে অবৈধ শিকার এবং বাসস্থান ধ্বংসের কারণে কিছু অঞ্চলে সংখ্যা কমতে পারে। বর্তমানে এটি সংরক্ষণের আওতাধীন এবং অস্ট্রেলিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
মোলাচ গিরগিটি মরুভূমির এক আশ্চর্যজনক সরীসৃপ, যার শক্তিশালী দেহ, বিশেষ আত্মরক্ষা কৌশল এবং প্রাকৃতিক অভিযোজন প্রকৃতির মধ্যে এক বিরল সৃষ্টি। এর কাঁটাযুক্ত শরীর এবং খাবারের প্রতি অনুরাগ জীববৈচিত্র্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে।
৭. ইগুয়ানা (Iguana)
ইগুয়ানা (Iguana) হল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী বড় আকারের গিরগিটি, যা মূলত মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গল এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে দেখা যায়। এরা লম্বা লেজ, শক্তিশালী পা, এবং দেহের উজ্জ্বল রঙের জন্য বিখ্যাত।
ইগুয়ানা গড়ে ১.৫ থেকে ২ মিটার (৫-৭ ফুট) লম্বা হয় এবং ওজন ৪-৮ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এদের দেহ সবুজ, ধূসর বা বাদামি রঙের হতে পারে, যা পরিবেশের সঙ্গে সহজে মিশে যেতে সাহায্য করে। এদের পিঠ বরাবর একটি কাঁটাযুক্ত রেখা এবং নিচের চিবুকে ফোলানো চামড়ার স্তর (Dewlap) থাকে, যা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইগুয়ানা সাধারণত নিরীহ এবং প্রধানত নিরামিষভোজী। এরা গাছের পাতা, ফুল, ফল এবং কখনো কখনো ছোট পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে। গাছের ডালে চমৎকারভাবে চলাফেরা করতে পারে এবং বিপদের সময় দ্রুত লাফিয়ে জল বা স্থলভাগে পালাতে সক্ষম।
স্ত্রী ইগুয়ানা প্রতি বছর ২০-৭০টি ডিম পাড়ে, যা মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ৩-৪ মাস সময় লাগে। ইগুয়ানারা সাধারণত ১০-২০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে, তবে পোষা অবস্থায় সঠিক পরিচর্যা পেলে ২৫ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
ইগুয়ানার লম্বা ও শক্তিশালী লেজ অন্যতম আত্মরক্ষার অস্ত্র। শিকারির আক্রমণ ঠেকাতে এরা লেজ দিয়ে আঘাত করতে পারে এবং প্রয়োজনে লেজ ফেলে পালিয়ে যেতে পারে। এছাড়া, বিপদের সময় এরা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে।
ইগুয়ানার কিছু প্রজাতি বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে, কারণ বন উজাড়, শিকার এবং পোষা প্রাণী হিসেবে অতিরিক্ত সংগ্রহের কারণে এদের সংখ্যা কমছে। বিভিন্ন সংরক্ষণ সংস্থা ইগুয়ানাদের আবাসস্থল রক্ষায় কাজ করছে।
ইগুয়ানা প্রকৃতির এক বিস্ময়কর ও নিরীহ সরীসৃপ, যা গাছের ডালে দক্ষতার সঙ্গে চলাফেরা করতে পারে এবং খাদ্য শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের সংরক্ষণ ভবিষ্যৎ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৮. আর্মাডিলো গিরগিটি (Armadillo Girdled Lizard)
আর্মাডিলো গিরগিটি (Ouroborus cataphractus) হল দক্ষিণ আফ্রিকার শুষ্ক ও আধা-মরুভূমি অঞ্চলে বসবাসকারী একটি অনন্য গিরগিটি প্রজাতি। এর বিশেষ আত্মরক্ষা কৌশল, শক্তিশালী দেহের কাঠামো এবং সামাজিক আচরণের জন্য এটি সরীসৃপ প্রেমীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।
এই গিরগিটির শরীর শক্তিশালী এবং কাঁটাযুক্ত আঁশে ঢাকা, যা শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কার্যকর। এদের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৮-১০ সেন্টিমিটার (৩-৪ ইঞ্চি) হয় এবং রঙ হলুদ-বাদামি বা হালকা ব্রোঞ্জ রঙের হতে পারে, যা পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে।
আর্মাডিলো গিরগিটির সবচেয়ে বিখ্যাত আত্মরক্ষা কৌশল হল বিপদের সময় এটি শরীর গোল করে লেজ মুখের মধ্যে গুটিয়ে নেওয়া, যা দেখতে অনেকটা আর্মাডিলোর মতো লাগে। এই অবস্থায় শরীরের কাঁটাযুক্ত অংশ বাইরের দিকে থাকে, ফলে শিকারিরা সহজে এটিকে ধরতে পারে না।
এরা মূলত কীটপতঙ্গভুক এবং ছোট পোকামাকড়, উইপোকা, বিটল ও অন্যান্য ছোট প্রাণী খেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে এরা ছোটখাটো উদ্ভিদ এবং ফুলও খেয়ে থাকে। অন্যান্য অনেক গিরগিটির মতো ডিম পাড়ার পরিবর্তে আর্মাডিলো গিরগিটি সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে (Viviparous)। সাধারণত প্রতি বছর একটি বা দুটি বাচ্চা জন্ম নেয়। এরা প্রায় ১০-১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
আর্মাডিলো গিরগিটি অবৈধভাবে পোষা প্রাণী হিসেবে সংগ্রহের কারণে হুমকির মুখে পড়ছে। এছাড়া, বন উজাড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এদের বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এদের সংরক্ষণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
আর্মাডিলো গিরগিটি প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি, যার বিশেষ আত্মরক্ষা কৌশল এবং সামাজিক আচরণ একে অন্যান্য গিরগিটি থেকে আলাদা করেছে। এদের সংরক্ষণ করা হলে প্রকৃতির এই অনন্য জীব বৈচিত্র্য ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।
৯. ফ্ল্যাপ-নেক গিরগিটি (Flap-neck Chameleon)
ফ্ল্যাপ-নেক গিরগিটি (Chamaeleo dilepis) আফ্রিকার অন্যতম জনপ্রিয় গিরগিটি প্রজাতি, যা বিশেষভাবে এর আশ্চর্যজনক রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতা এবং গলায় থাকা চামড়ার ভাঁজের (flap) জন্য পরিচিত। এটি বনাঞ্চল, তৃণভূমি এবং শুষ্ক এলাকায় সহজেই দেখা যায়।
ফ্ল্যাপ-নেক গিরগিটির দেহের গড় দৈর্ঘ্য ২৫-৩৫ সেন্টিমিটার (১০-১৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। এর ত্বকের রং প্রধানত সবুজ বা বাদামি হয়, তবে পরিবেশ ও আবেগের উপর নির্ভর করে এটি দ্রুত রং পরিবর্তন করতে পারে। এর গলার পাশে দুটি বড় চামড়ার ভাঁজ থাকে, যা বিপদের সময় প্রসারিত হয় এবং শিকারিকে ভয় দেখাতে সাহায্য করে।
এটি ধীরগতির গিরগিটি, যা শিকার ধরার সময় ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এবং হঠাৎ করে লম্বা জিহ্বা ছুঁড়ে শিকার ধরে। বিপদের সময় এটি পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে রঙ পরিবর্তন করতে পারে। এছাড়া, এটি শরীর ফুলিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে এবং অনেক সময় এক জায়গায় স্থির হয়ে যায়, যাতে শিকারির চোখে না পড়ে।
ফ্ল্যাপ-নেক গিরগিটি মূলত কীটপতঙ্গভুক এবং প্রধানত পতঙ্গ, গুবরে পোকা, মাকড়সা এবং ছোট সরীসৃপ খেয়ে থাকে। এরা তাদের দীর্ঘ ও আঠালো জিহ্বা ব্যবহার করে খুব দ্রুত শিকার ধরতে পারে। মেয়ে ফ্ল্যাপ-নেক গিরগিটি প্রতি প্রজনন ঋতুতে ২৫-৫০টি ডিম পাড়ে, যা মাটির নিচে রাখা হয়। ডিম ফুটতে ৪-১২ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এদের গড় আয়ু সাধারণত ৫-৮ বছর হয়।
এরা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত থাকলেও পোষা প্রাণী হিসেবে সংগ্রহ এবং বাসস্থান ধ্বংসের কারণে কিছু অঞ্চলে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে বর্তমানে এটি বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নেই। ফ্ল্যাপ-নেক গিরগিটি রঙ পরিবর্তন, শিকার ধরার দক্ষতা এবং প্রতিরক্ষা কৌশলের জন্য প্রকৃতির এক বিস্ময়। এটি পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই এর সংরক্ষণ ও সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১০. লেপার্ড গেকো গিরগিটি (Leopard gecko)
লেপার্ড গেকো (Eublepharis macularius) একটি ছোট, নিরীহ এবং জনপ্রিয় গিরগিটি, যা মূলত দক্ষিণ এশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান এবং ইরানের শুষ্ক ও পাথুরে অঞ্চলে বসবাস করে। এটি পোষা প্রাণী হিসেবেও অত্যন্ত জনপ্রিয়, কারণ এটি সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং যত্ন নেওয়া সহজ।
লেপার্ড গেকোর গড় দৈর্ঘ্য ২০-২৭ সেন্টিমিটার (৮-১১ ইঞ্চি) হয় এবং ওজন ৫০-৮০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। এর শরীর হলুদ বা সোনালি রঙের হয়, যার ওপর কালো দাগ থাকে, যা দেখতে চিতাবাঘের (Leopard) মতো লাগে। এ কারণেই এর নাম লেপার্ড গেকো। অন্য গেকোদের মতো এর ত্বক আর্দ্র নয়, বরং খসখসে এবং দেহের নিচের অংশ ফ্যাকাসে সাদা রঙের হয়।
লেপার্ড গেকো নিশাচর প্রাণী, যা রাতে বেশি সক্রিয় থাকে। শিকার ধরতে এটি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ব্যবহার করে। বিপদের সময় এটি তার লেজ ফেলে দিতে পারে (Autotomy), যা পরে আবার নতুন করে গজায়। এর লেজে চর্বি জমা থাকে, যা খাবারের সংকটকালীন সময়ে শক্তি সরবরাহ করে।
লেপার্ড গেকো মূলত মাংসাশী এবং প্রধানত বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়, যেমন কৃমি, ক্রিকেট, তেলাপোকা এবং ছোট মাকড়সা খেয়ে থাকে। এরা মাঝে মাঝে ছোট সরীসৃপও শিকার করতে পারে।
মেয়ে লেপার্ড গেকো প্রতি মৌসুমে ২-৩টি করে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ৩৫-৮৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। সঠিক যত্নের মাধ্যমে এটি ১৫-২০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ২৫ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকে। লেপার্ড গেকো বন্য পরিবেশে খুব বেশি হুমকির মুখে নেই, তবে পোষা প্রাণী হিসেবে অতিরিক্ত সংগ্রহ এবং আবাসস্থলের ক্ষতির কারণে কিছু অঞ্চলে সংখ্যা কমতে পারে।
লেপার্ড গেকো তার আকর্ষণীয় চেহারা, সহজ যত্ন এবং দীর্ঘ জীবনকাল জন্য সরীসৃপ প্রেমীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি, যা রাতের পরিবেশে শিকার ধরার দক্ষতা এবং আত্মরক্ষার অভিনব কৌশল দেখায়।
গিরগিটি প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। এদের রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতা, শিকার ধরার কৌশল এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা সত্যিই চমকপ্রদ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রজাতির গিরগিটি আমাদের প্রকৃতির বৈচিত্র্য এবং জীববৈচিত্র্যের সৌন্দর্য প্রকাশ করে।
বিশ্বের শীর্ষ ১০ গিরগিটি
১. প্যান্থার গিরগিটি (Panther Chameleon)
২. জ্যাকসন গিরগিটি (Jackson’s Chameleon)
৩. কমডো ড্রাগন (Komodo Dragon)
৪. ব্রোকেসিয়া গিরগিটি (Brookesia Chameleon)
৫. থর্নি ডেভিল (Thorny Devil)
৬. মোলাচ গিরগিটি (Moloch Lizard)
৭. ইগুয়ানা (Iguana)
৮. আর্মাডিলো গিরগিটি (Armadillo Girdled Lizard)
৯. ফ্ল্যাপ-নেক গিরগিটি (Flap-neck Chameleon)
১০. লেপার্ড গেকো গিরগিটি (Leopard gecko)