আগ্নেয়গিরি ভূ-পৃষ্ঠের এমন একটি গঠন, যেখানে ভূগর্ভস্থ গলিত শিলা (ম্যাগমা), গ্যাস এবং অন্যান্য উপাদান বিস্ফোরণের মাধ্যমে বা ধীরে ধীরে নির্গত হয়। যখন এই ম্যাগমা ভূ-পৃষ্ঠে উঠে আসে, তখন তাকে লাভা বলা হয়। লাভা ঠান্ডা হয়ে শক্ত হয়ে গেলে আগ্নেয়গিরির আকৃতি তৈরি হয়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত- পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভৌগোলিক ঘটনা। এটি এমনি একটি ঘটনা যা বেশ কয়েকবার পৃথিবীতে গনবিলুপ্তি ঘটিয়েছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক-পারমিয়ান গণবিলুপ্তির কারণ ছিল শুধুমাত্র আগ্নেয়গিরি।
কিভাবে আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হয়?
আমাদের পৃথিবীর গভীরের তাপমাত্রা খুব ই বেশি, প্রায় ছ’হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আর পৃথিবীর উপরিভাগ কিছু প্লেটের সমন্বয়ে তৈরি। এখানে রয়েছে ৭ টি মেজর টেক্টনিক প্লেট বা ভারী প্লেট ও ২৬ টি মাইনর টেক্টনিক বা হালকা প্লেট। প্লেটগুলো সর্বদা গতিশীল। ফলে, প্রায়ই এদের মধ্যে সংঘর্ষ বা এদের সংযোগস্থলে চাপের সৃষ্টি হয়। দুই প্লেটের সংযোগস্থলে চাপের ফলে সৃষ্টি হয় পাহাড়। যেমন হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়েছে, ইন্ডিয়ান প্লেটের সাথে ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষের ফলে। ধাক্কার সময় একটি তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা বলি ভূমিকম্প।
ভূ-পৃষ্ঠ এবং পৃথিবীর কেন্দ্রে গলিত লোহার মাঝামাঝি একটি কঠিন শিলাস্তর রয়েছে। যাকে ম্যান্টল বলা হয়। চাপের পাশাপাশি ২ প্লেটের মাঝামাঝি প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি হয়। যা শিলাস্তর বা ম্যান্টলকে গলিয়ে ফেলে। এবং সৃষ্ট চাপ এই গলিত পদার্থকে পৃথিবীর পৃষ্ঠে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে। গলিত পদার্থ ভূ-পৃষ্ঠে জমা হয় এবং ঠাণ্ডা হয়ে তৈরি করে বিশাল বিশাল পর্বত। এই পাহারগুলোকেই গুলোকেই আমরা আগ্নেয়গিরি বলে থাকি।
মূলত তিনটি কারণে আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হতে পারে—
টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ (Convergent Boundary)
যখন দুটি প্লেট একে অপরের দিকে ধাবিত হয়, তখন এক প্লেট অপরটির নিচে ঢুকে যায় (সাবডাকশন)। এতে ভূগর্ভস্থ শিলা প্রচণ্ড তাপে গলে যায় এবং ম্যাগমা তৈরি হয়। ম্যাগমা চাপের কারণে ভূ-পৃষ্ঠ ফাটিয়ে বের হয়ে আসে এবং আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়।
টেকটোনিক প্লেটের বিচ্ছেদ (Divergent Boundary)
যখন দুটি প্লেট পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়, তখন ফাঁকা অংশে ভূগর্ভস্থ ম্যাগমা উঠে আসে। এটি ধীরে ধীরে জমে আগ্নেয়গিরির জন্ম দেয়।
হটস্পট (Hot Spot)
কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ তাপ অনেক বেশি থাকে, যা ম্যাগমাকে গলিয়ে ভূ-পৃষ্ঠে ঠেলে দেয়। এটি প্লেটের গতির সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করতে পারে এবং নতুন আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি করতে পারে।
এই আগ্নেয়গিরি ৩ ধরণের হয়ে থাকে।
-সক্রিয়
-সুপ্ত
-মৃত
বর্তমানে অগ্ন্যুৎপাত ঘটাচ্ছে বা সাম্প্রতিক সময়ে অগ্ন্যুৎপাত ঘটিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও অগ্ন্যুৎপাত ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে এমন আগ্নেয়গিরিকে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি বলা হয়। এটি ভূগর্ভস্থ ম্যাগমা চেম্বার থেকে নিয়মিতভাবে লাভা, গ্যাস ও ছাই নির্গত করতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীতে এরকম আগ্নেয়গিরির সংখ্যা প্রায় ১৫০০। মাউন্ট এটনা– ইতালি, কিলাউয়া– হাওয়াই, যুক্তরাষ্ট্র, সাকুরাজিমা– জাপান, মাউন্ট মেরাপি – ইন্দোনেশিয়া, ইয়েলোস্টোন সুপারভলকানো (Yellowstone Supervolcano)– যুক্তরাষ্ট্র, পোপোকেটাপেটল, মেক্সিকো সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আগ্নেয়গিরির উদাহরণ।
যেসব আগ্নেয়গিরি অনেকদিন পর পর হঠাৎ জেগে ওঠে, হঠাৎ জ্বালা মুখ দিয়ে উত্তপ্ত পাথর, ছাই বেরিয়ে আসে তাদের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি বলে। এটি খুব ভয়ানক। কারণ কেউ জানে না কখন এই আগ্নেয়গিরি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে। জাপানের ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরি, ফিলিপাইনের মায়ান আগ্নেয়গিরি হলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উদাহরণ। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে রয়েছে এই ভয়ঙ্কর সুপ্ত আগ্নেয়গিরি।
পৃথিবীর যেসব আগ্নেয়গিরি থেকে আর অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা নেই , সেগুলোকে মৃত আগ্নেয়গিরি বলে। আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো, বার্মার পোপা এগুলি হলো পৃথিবীর বুকে ঘুমিয়ে থাকা কিছু মৃত আগ্নেয়গিরির উদাহরণ।
এবার আমরা জানবো কিছু আগ্নেয়গিরির কথা, যা অতীত তথা বর্তমানেও ছাপ রেখে চলছে প্রতিনিয়ত।
মাউন্ট এটনা,ইতালি- মাউন্ট এটনা সিসিলি দ্বীপের পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। এটি ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু আগ্নেয়গিরি,যার উচ্চতা ৩,৩২৯ মিটার। এটি আফ্রিকা প্লেট ও ইউরোশিয়া প্লেটের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ১৯৭০ সালে এই আগ্নেয়গিরি থেকে ধোয়ার কুন্ডলী বের হতে দেখা গিয়েছিল। ২০২০ সালে পুনরায় এ ধরণের ঘটনা দেখা যায়।
মাউন্ট নিরাগঙ্গো,কঙ্গো- এই আগ্নেয়গিরি আফ্রিকার কঙ্গো তে অবস্থিত। বর্তমানে সবচেয়ে বড় সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। ১৮৮২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৩৪ বার এটি বিস্ফোরণ হয়েছে। ১৯৭৭ এর বিস্ফোরণে ৬০ মাইল গতিতে লাভা পাশের গ্রামে ছড়িয়ে যায় এবং এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রায় ৭০ জনের মৃত্যু সহ প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট লাভা হ্রদের গভীরতা ৭০০ মিটার,এটি পৃথিবীর গভীরতম লাভা হ্রদ।
মাউন্ট মেরাপি,ইন্দোনেশিয়া- ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি মাউন্ট মেরাপি। ২০১০ সালে এখানে ভয়াবহ অগ্নুৎপাত হয়। বিপর্যয়ের আশঙ্কা পেয়ে কর্তৃপক্ষ আগেই ১১,০০০ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যায় নিরাপদ স্থানে।
মাউন্ট ভিসুভিয়াস, ইতালি- ইতালির নেপলস উপকূলে অবস্থিত মাউন্ট ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি। এটি ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত, বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে এখানে অসংখ্য বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে, বর্তমানে আগ্নেয়গিরিটি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে।
পোপোকেটাপেটল, মেক্সিকো- এটি দক্ষিণ আফ্রিকার মেক্সিকো অঞ্চলে অবস্থিত একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। পোপোকেটাপেটল কথার অর্থ হলো ‘ধোঁয়ার পাহাড়’। মেক্সিকোর দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ এল পোপো নামেও পরিচিত।
আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি ভূ-তাত্ত্বিক কার্যকলাপের ফল। এটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে নতুন ভূমির সৃষ্টি, উর্বর মাটি এবং ভূ-তাপীয় শক্তি উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সক্রিয় আগ্নেয়গিরি পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এগুলো আশপাশের পরিবেশ ও আবহাওয়ায় প্রভাব ফেলে এবং কখনো কখনো ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। তবে এগুলো নতুন ভূমি তৈরি ও উর্বর মাটি গঠনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।