প্রকৃতির অপার রহস্যের মাঝে মা-বাবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা অন্যতম বিস্ময়কর বিষয়। কিছু প্রাণী আছে যারা সন্তান জন্মের পর কোনো যত্নই নেয় না, আবার কিছু প্রাণী আছে যারা নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে সন্তানদের সুরক্ষা ও লালন-পালনের জন্য। এই প্রতিবেদনে আমরা এমন পাঁচটি প্রাণীর কথা জানব, যারা সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে।
১. ওয়েডেল সিল (Weddell Seal)
ওয়েডেল সিল পৃথিবীর অন্যতম কঠিন জলবায়ুর দক্ষিণ মেরুর বরফাচ্ছন্ন অঞ্চলে বসবাস করে। মা ওয়েডেল সিল একাই সন্তান লালনের সমস্ত দায়িত্ব নেয়। সন্তানদের খাবারের ব্যবস্থা করতে তারা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বরফশীতল পানিতে ডাইভ করে, এমনকি নিজের শারীরিক শক্তি হারিয়ে ফেললেও পিছপা হয় না।
১১ মাসের দীর্ঘ গর্ভধারণ শেষে মা ওয়েডেল সিল সন্তান জন্ম দেয় এবং বিপদসংকুল পরিবেশে বেঁচে থাকার শিক্ষা দেওয়া শুরু করে। মাত্র দুই সপ্তাহ বয়সেই বাচ্চাদের পানিতে নামতে শেখায়। তারা পানির নিচে দিক চিনতে, নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বরফে ছিদ্র খুঁজে বের করতে এবং দাঁত দিয়ে বরফে ছিদ্র তৈরি করতে শেখে।
প্রতি বছর মা ওয়েডেল সিল একটি মাত্র বাচ্চা জন্ম দেয় এবং তাকে পুরো বছর যত্ন করে, যদিও এতে তার শারীরিক অবস্থা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের দুধে প্রায় ৬০% ফ্যাট থাকে, যা বাচ্চাদের দ্রুত বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।
২. ওরাংওটাং (Orangutan)
এই বুদ্ধিমান প্রাণীদের সাধারণত সুমাত্রা (ইন্দোনেশিয়া) ও বোর্নিওর (মালয়েশিয়া) রেইন ফরেস্টে পাওয়া যায়। মা ওরাংওটাং সন্তানের জন্য অবিশ্বাস্য ত্যাগ স্বীকার করে। প্রায় আট বছর ধরে মা তার সন্তানের পাশে থাকে, খাবার সংগ্রহ ও আশ্রয় তৈরিতে সাহায্য করে।
শিশু ওরাংওটাং মায়ের কাছ থেকে শেখে কোথায় ভালো ফল পাওয়া যায়, কখন তা পরিপক্ব হয়, এবং কীভাবে নিরাপদে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। সবচেয়ে জটিল কাজ হচ্ছে বাসা তৈরি করা, যা তারা ছয় মাস বয়স থেকে অনুশীলন শুরু করে এবং তিন-চার বছর বয়সে সফলভাবে করতে পারে।
৩. সিসিলিয়ানস (Caecilians)
সিসিলিয়ানস হলো একধরনের অ্যাম্ফিবিয়ান, যাদের মা সন্তানদের জন্য সবচেয়ে চরম ত্যাগ স্বীকার করে। জন্মের পর মা তাদের প্রথম খাদ্য হিসেবে নিজের শরীরের চামড়া খেতে দেয়! এতে বাচ্চারা প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় এবং ধীরে ধীরে বড় হয়। এটি প্রাণিজগতে বিরল এবং অত্যন্ত বিস্ময়কর এক আত্মত্যাগ।
সিসিলিয়ানস সাধারণত রেইন ফরেস্টের মাটির নিচে বাস করে এবং বেশিরভাগ সময় অন্ধকার পরিবেশে কাটায়।
৪. অ্যাডেলি পেঙ্গুইন (Adelie Penguin)
অ্যান্টার্কটিকার হিমশীতল আবহাওয়ায় অ্যাডেলি পেঙ্গুইনদের মা-বাবা সন্তান লালন-পালনে অবিশ্বাস্য ত্যাগ স্বীকার করে। পুরুষ অ্যাডেলি পেঙ্গুইন প্রায় ৫,০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সঙ্গিনীর কাছে ফিরে আসে। ডিম দেওয়ার পর মা খাবারের সন্ধানে সমুদ্রে চলে যায়, আর বাবা পেঙ্গুইন শূন্য ডিগ্রির নিচের তাপমাত্রায় দাঁড়িয়ে ডিমের যত্ন নেয়। তুষারঝড় ও হাড়কাঁপানো শীতেও তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না মা ফিরে আসে।
ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পর মা-বাবা উভয়েই পালাক্রমে তাদের লালন-পালন করে। তবে যদি কোনো কারণে বাবা ফিরে না আসে, তাহলে মা ডিমটি ফেলে চলে যায়, কারণ একার পক্ষে সন্তান প্রতিপালন করা সম্ভব নয়।
৫. ক্লাউন ফিশ (Clownfish)
ক্লাউন ফিশের মা-বাবার ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ প্রাণিজগতে ব্যতিক্রমী। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যখন মা মারা যায়, তখন বাবা ক্লাউন ফিশ লিঙ্গ পরিবর্তন করে মায়ের ভূমিকা গ্রহণ করে!
বাচ্চা জন্মের আগে তারা পাথুরে একটি গর্ত পরিষ্কার করে রাখে, যা নবজাতকের জন্য আশ্রয় হিসেবে কাজ করে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পর বাবা-মা উভয়েই তাদের ফিনের সাহায্যে অক্সিজেন সরবরাহ করে, যাতে তারা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
প্রাণিজগতে মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের এমন বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত সত্যিই অভূতপূর্ব। এসব প্রাণীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আমাদের শেখায় যে আত্মত্যাগ ও স্নেহ শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমস্ত প্রাণিজগতেই বিদ্যমান।