রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্তৃত দেশ, যার আয়তন প্রায় ১.৭ কোটি বর্গকিলোমিটার। এটি ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত এবং ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। শত শত বছর ধরে রাশিয়া নানা ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করেছে, তবে ভবিষ্যতে এটি এক নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
রাশিয়ার ঐতিহাসিক সমস্যা
রাশিয়া তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছে—
১. প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়া ও কৃষির সীমাবদ্ধতা
রাশিয়ার বিশাল অংশজুড়ে সাইবেরিয়া, যেখানে বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে।
কৃষিকাজের জন্য খুব কম জায়গা উর্বর, ফলে খাদ্য উৎপাদন সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।
২. বরফাচ্ছন্ন সমুদ্র বন্দর
রাশিয়ার অধিকাংশ উপকূলীয় অঞ্চল বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে আবৃত থাকে, ফলে সমুদ্র বাণিজ্য সীমিত হয়ে পড়ে। আইসব্রেকার ব্যবহারের প্রয়োজন হয়, যা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ।
৩. সামরিক আক্রমণের ঝুঁকি
রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্ত বিশাল সমতলভূমির মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত, যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের আক্রমণের শিকার হয়েছে। নেপোলিয়ন, হিটলারসহ বিভিন্ন শাসকরা রাশিয়ায় হামলা চালিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন: রাশিয়ার জন্য আশীর্বাদ?
বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন এক বিপর্যয় হলেও রাশিয়ার জন্য এটি একটি সম্ভাবনা নিয়ে আসছে।
১. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সাইবেরিয়ার বরফ কমছে, ফলে নতুন কৃষি অঞ্চল তৈরি হচ্ছে। গবেষণা অনুযায়ী, ২০৮০ সালের মধ্যে ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা কৃষির জন্য উপযোগী হয়ে উঠবে।
রাশিয়া বর্তমানে বিশ্বের ২৫ ভাগ গম উৎপাদন করে, যা আগামী দিনে আরও বাড়বে।
২. সমুদ্র বাণিজ্যের প্রসার
উত্তর মহাসাগরের বরফ গলে যাওয়ায় নতুন নৌপথ তৈরি হচ্ছে, যা রাশিয়ার বাণিজ্যের জন্য বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করবে। চীন ইতোমধ্যে রাশিয়ার এই নতুন নৌপথগুলোতে ২০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ভবিষ্যতে উত্তর মহাসাগর রুট ব্যবহার করে ইউরোপ-এশিয়া বাণিজ্য আরও সহজ হবে।
৩. নতুন জনবসতির সম্ভাবনা
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ জলবায়ু সংকটে পড়বে, যার ফলে বিপুল পরিমাণ অভিবাসী নতুন আবাস খুঁজবে। সাইবেরিয়া ক্রমশ বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে এবং রাশিয়া নতুন জনসংখ্যা গ্রহণ করতে পারে।
রাশিয়ার ভবিষ্যৎ বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অবস্থান
রাশিয়া বিশ্ব রাজনীতিতে বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে পরিচিত। বিশাল ভূখণ্ড, প্রাকৃতিক সম্পদ, সামরিক শক্তি এবং ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এটি বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতে রাশিয়ার অবস্থান আরও শক্তিশালী হতে পারে।।
১. শক্তিশালী কৃষি ও খাদ্য রপ্তানি কেন্দ্র
বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে রাশিয়ার বিশাল অঞ্চল কৃষিকাজের জন্য উর্বর হয়ে উঠছে। ২০৮০ সালের মধ্যে ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা কৃষির জন্য ব্যবহারযোগ্য হতে পারে। রাশিয়া বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২৫% গম উৎপাদন করে এবং ভবিষ্যতে এটি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। খাদ্য সংকটে থাকা দেশগুলো রাশিয়ার কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে।
২. নতুন বাণিজ্য পথ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
বরফ গলে যাওয়ার ফলে Northern Sea Route (NSR) বিশ্ব বাণিজ্যের নতুন প্রধান পথ হয়ে উঠতে পারে। চীন-ইউরোপের মধ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য এই পথ ব্যবহার করা হলে সময় ও খরচ উভয়ই কমবে। ইতোমধ্যে চীন ২০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে রাশিয়ার এই নতুন বাণিজ্য পথে। রাশিয়ার নৌবন্দরগুলো বছরের অধিকাংশ সময় খোলা থাকবে, যা সমুদ্র বাণিজ্যের সুযোগকে বহুগুণ বাড়াবে। রাশিয়ার বিশাল খনিজ সম্পদ উত্তোলনের সুযোগও বাড়বে।
৩. জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের আধিপত্য
রাশিয়া বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে এবং অন্যতম বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ। সাইবেরিয়ার নতুন অঞ্চলগুলো বসবাসের উপযোগী হলে, সেখানে খনিজ অনুসন্ধান ও উত্তোলন সহজ হবে। রাশিয়া বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে তার প্রভাব আরও বাড়াতে পারবে।
৪. চীনের সঙ্গে কৌশলগত মিত্রতা
রাশিয়া ও চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বাড়ছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং রাশিয়ার নতুন সমুদ্র বাণিজ্য পথের সংযোগ দুই দেশের সম্পর্ককে আরও গভীর করছে। ভবিষ্যতে রাশিয়া-চীন জোট পশ্চিমা বিশ্বের জন্য শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে।
৫. পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ও বিকল্প বাজার
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া নতুন বাণিজ্য বাজার তৈরি করছে। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে, যা ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়ক হবে। ভারত, ইরান, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা (BRICS) জোটের মাধ্যমে বিকল্প অর্থনৈতিক সংযোগ গড়ে তুলছে।
৬. সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা নীতি
রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর মালিক, যা পরমাণু অস্ত্রসহ উন্নত প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ। উত্তর মহাসাগর ও আর্কটিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে, যা নতুন ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। ভবিষ্যতে রাশিয়া তার প্রতিরক্ষা শিল্পকে আরও আধুনিকায়ন করতে পারে এবং অস্ত্র রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।
৭. অভিবাসী সংকট ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি
রাশিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র ১৪ কোটি, যা বিশাল ভূখণ্ডের তুলনায় খুবই কম। ভবিষ্যতে রাশিয়া জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে, যা তাদের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
রাশিয়া এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। জলবায়ু পরিবর্তন যেখানে অনেক দেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ, সেখানে রাশিয়ার জন্য এটি সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিচ্ছে। আগামী শতাব্দীতে রাশিয়া কৃষি, সমুদ্র বাণিজ্য এবং অভিবাসন ব্যবস্থার দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হতে পারে। তবে এই পরিবর্তন ইতিবাচক হবে নাকি নেতিবাচক, সেটি নির্ভর করবে রাশিয়ার কৌশলগত সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর।