‘পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
রয়েছে অনেক কাক এ-উঠানে তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক
নাই আর; অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক
দাঁড়কাক দেখা যেত দিন রাত-সে আমার ছেলেবেলাকার
কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার:’
– রূপসী বাংলা
জীবনানন্দ দাশের কবিতা প্রকৃতির গভীরতর ছোঁয়া মিশানো। তিনি পাখিদের কবি। কবি জীবনানন্দকে পাখপাখালি গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর কবিতায় ৭৭ প্রজাতির পাখির নাম পাওয়া যায়, যারা দুই বাংলায় এক বা একাধিক আঞ্চলিক নামে পরিচিত। তাঁর কবিতায় দুই প্রজাতির কাকের কথা ও বর্ণনা পাওয়া যায়। পাতি কাক ও দাঁড়কাক।
তিনি দাঁড়কাক কে দেখেছেন পথহারা পাখি হিসেবে, যেমন – ‘যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধ্যান,/ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; এইখানে ধুন্দুল লতাতে’। আবার বলেছেন এ পাখি একা একা রাত জাগে তখন পৃথিবীর অন্য কোন পাখি আর জেগে নেই, যেমন রূপসী বাংলায়-‘ তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায়;/পৃথিবীও নাই আর; দাঁড়কাক একা একা সারারত জাগে;/‘কি বা, হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।’
সন্ধ্যাবেলায় যে যার ঘরে ফিরে আসে আপনজনের ডাকে। কবি দেখেছেন সাঁেঝরবেলায় দাঁড়কাকও ফিরে আসে তার বাসায় মুখে দুটি খড় নিয়ে। যেমন-
জানি নাকো:- আমি এই বাংলার পাড়াগাঁয়ে বাঁধিয়াছি ঘর:
সন্ধ্যায় যে দাঁড়কাক উড়ে যায় তালবনে- মুখে দু’টো খড়
একসময় গ্রামবাংলায় প্রচুর পরিমাণে দাঁড়কাক দেখা যেত। এখন আর আগের মতো দেখা যায় না। পাখির এ কমে যাওয়া কবির মনে বিষণ্নতা এনে দিয়েছে। এরকম অসংখ্য উপমায় কবি দাঁড়কাককে তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়।
দাঁড়কাক কালো ও নীলচে আভা মিশানো পালকের পাখি। ঠোঁট বড় এবং শক্ত। চোখ বাদামি। দাঁড়কাক গ্রামের বেশি দেখা যায়। প্রতি গ্রামেই কয়েক জোড়া দাঁড়কাক থাকে। মাঝে মাঝে তারা খাবারের উৎস পেলে সমবেত হয়। দাঁড় কাক শহড়ে কম দেখা যায়। সব বিভাগের বনেও দেখা যায়।
দাঁড়কাক বাংলাদেশে সুলভ আবসিক পাখি। সচরাচর বৃক্ষবহুল বন, বনের ধারে, ফলবাগান, লোকালয়ে ও ভাগাড়ে বিচরণ করে। সাধারণত জোড়ায় অথবা ছোট দলে থাকে। সব ধরণের পরিবেশ থেকে খাবার সংগ্রহ করতে পারে। এরা সর্বভূক তবে খাদ্য তালিকায় রয়েছে পাকা ফল, পোকমাকড়, উচ্ছিষ্ট, মৃতদেহ, পচা মাংস ইত্যাদি।
দাঁড়কাক সাহসী ও কৌতুহলী পাখি। মানুষ দেখলে বিচলিত হয়না। গৃহপালিত হাঁস-মুরগীর ছানা ধরতে এরা নানান কৌশল অবলম্বন করে। ছেলেবেলায় আমরা মাথায় দাঁড়কাকের ঠোকর খেয়েছি। এরা উঠানে সেদ্ধ ধান খেতে আসে। মাঝে মাঝে গভীর শব্দে ডাকে- ক্রা..ক্রা..। নভেম্বর-এপ্রিল মাসে বনের ধারের বড় গাছে শুকনো ডাল,কাঠি, পাতা, নারিকেলের ছোবরা, পশম ইত্যাদি দিয়ে মাচার মতো বাসা বানয়। বাসা ৩-৫ টি ডিম পাড়ে। ডিম ফেটে ১৭-১৯ দিনে। কাকছানার বাসা ছারে চার সপ্তাহে।
সৌরভ মাহমুদ
প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
nature.sourav@gmail.com