মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কাগজের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। শিক্ষা, তথ্য সংরক্ষণ, শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে অফিসিয়াল কাজ- সব ক্ষেত্রেই কাগজের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, কাগজ কীভাবে তৈরি হয়? গাছ থেকে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়াটি যতটা সাধারণ মনে হয়, আসলে তা একটি জটিল এবং পরিশ্রমী প্রক্রিয়া। চলুন, কাগজ উৎপাদনের ধাপগুলো বিস্তারিতভাবে জানি।
১. গাছ সংগ্রহ ও কাটা
কাগজ তৈরির প্রথম ধাপ হলো কাঠ সংগ্রহ। সাধারণত সফটউড (পাইন, স্প্রুস) এবং হার্ডউড (ইউক্যালিপটাস, ম্যাপল) গাছ কাগজ তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। গাছ সংগ্রহের পর সেগুলো কেটে ছোট ছোট লগ বা টুকরো করা হয়।
২. ডিবার্কিং (ছাল ছাড়ানো)
গাছ থেকে কাগজ তৈরির জন্য কাঠের বাইরের ছাল বা বাকল অপসারণ করা হয়। একটি বিশেষ ডিবার্কিং মেশিনের মাধ্যমে ছাল ছাড়ানো হয়। এই ছালগুলো জ্বালানি বা মাটির সারের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৩. চিপিং (কাঠ চূর্ণ করা)
ডিবার্কিংয়ের পর কাঠকে ছোট ছোট চিপ বা টুকরোতে পরিণত করা হয়। কাঠ চূর্ণ করার জন্য চিপার মেশিন ব্যবহার করা হয়। এই কাঠের চিপগুলো পরবর্তী ধাপে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
৪. পাল্পিং (সজ্জা তৈরি)
কাগজ তৈরির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো পাল্পিং।
রাসায়নিক পাল্পিং: এখানে লিগনিন (কাঠের কঠিন অংশ) অপসারণের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়।
মেকানিক্যাল পাল্পিং: কাঠ চূর্ণ করে তন্তুগুলো আলাদা করা হয়।
সজ্জা প্রস্তুত: এই প্রক্রিয়ায় কাঠ থেকে সেলুলোজ তন্তু আলাদা করা হয়, যা কাগজ তৈরির মূল উপাদান।
৫. ওয়াশিং ও ব্লিচিং
পাল্প প্রস্তুতির পর তা ধোয়া ও ব্লিচ করা হয়।
ধোয়া: পাল্পের অবশিষ্ট লিগনিন ও ময়লা দূর করার জন্য তা ভালোভাবে ধোয়া হয়।
ব্লিচিং: কাগজকে সাদা এবং মসৃণ করার জন্য পাল্পে ব্লিচিং কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয়।
৬. কাগজের শিট তৈরি
পরিশোধিত পাল্প থেকে কাগজের শিট তৈরি করা হয়।
প্রক্রিয়া: পাল্পকে বড় ছাঁচের মধ্যে ঢেলে শুকানো হয়।
রোলিং: কাগজকে পাতলা ও মসৃণ করার জন্য রোলার মেশিন ব্যবহার করা হয়। এই ধাপে কাগজের আকার ও পুরুত্ব নির্ধারণ করা হয়।
৭. শুকানো ও কাটা
কাগজ তৈরি হওয়ার পর তা শুকিয়ে বিভিন্ন আকারে কাটা হয়।
– শুকানোর জন্য গরম বাতাস বা হিটিং মেশিন ব্যবহার করা হয়।
– প্রয়োজন অনুযায়ী কাগজকে রোল বা শীটে কেটে প্যাকেজ করা হয়।
পরিবেশ সচেতনতা
কাগজ তৈরির জন্য প্রচুর গাছের প্রয়োজন হয়, যা পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে।
পুনঃবনায়ন: ব্যবহৃত গাছের পরিবর্তে নতুন গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
রিসাইক্লিং: ব্যবহৃত কাগজ পুনঃব্যবহার করে কাগজ উৎপাদন করা পরিবেশবান্ধব।
গাছ থেকে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া কঠিন হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সহজ এবং পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা চলছে। তাই কাগজের ব্যবহার কমিয়ে এবং রিসাইক্লিংয়ের ওপর জোর দিয়ে আমরা পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি।