উইকিপিডিয়া একটি মুক্ত অনলাইন বিশ্বকোষ যা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে জ্ঞান প্রদান করে। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে যেকোনো ব্যক্তি তথ্য যোগ করতে, সম্পাদনা করতে বা শেয়ার করতে পারেন। উইকিপিডিয়া ২০০১ সালের ১৫ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে এবং এখন এটি বিশ্বের বৃহত্তম ও বহুল ব্যবহৃত রেফারেন্স ওয়েবসাইটে পরিণত হয়েছে।
১৯৯৫ সালে ওয়ার্ড কানিংহ্যাম প্রথমবারের মতো “উইকি” প্রযুক্তির ধারণা প্রস্তাব করেন। “উইকি” শব্দটি হাওয়াইয়ান ভাষা থেকে নেওয়া, যার অর্থ “দ্রুত”। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে ব্যবহারকারীরা সহজেই তথ্য সম্পাদনা এবং প্রকাশ করতে পারে। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে ২০০১ সালে জিমি ওয়েলস এবং ল্যারি স্যাঙ্গার “উইকিপিডিয়া” প্রতিষ্ঠা করেন। উইকিপিডিয়া একটি ওপেন সোর্স জ্ঞানভাণ্ডার, যা দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
উইকিপিডিয়ার সাফল্যের পর, জিমি ওয়েলস ২০০৩ সালে উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি একটি অলাভজনক সংস্থা, যা উইকিপিডিয়া সহ উইকিমিডিয়ার অন্যান্য প্রকল্প পরিচালনা করে। উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য হল বিশ্বের সকল মানুষের জন্য জ্ঞান সহজলভ্য করা এবং এটি বিনামূল্যে প্রদান করা।
উইকিমিডিয়া কীভাবে কাজ করে?
উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন একটি অলাভজনক সংস্থা, যা দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। এটি ওপেন সোর্স নীতিতে কাজ করে, যেখানে যে কেউ অবদান রাখতে এবং তথ্য সম্পাদনা করতে পারে। উইকিমিডিয়ার কাজ করার পদ্ধতি কয়েকটি ধাপে বিভক্ত:
প্রকল্পসমূহ পরিচালনা:
উইকিমিডিয়া বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
উইকিপিডিয়া: একটি মুক্ত বিশ্বকোষ।
উইকিশনারি: মুক্ত অভিধান।
উইকিকোট: উদ্ধৃতিসমূহের সংগ্রহ।
উইকিবুকস: মুক্ত বই ও টেক্সটবুক।
উইকিমিডিয়া কমন্স: ছবি, ভিডিও, এবং অডিও সংরক্ষণাগার।
উইকিসোর্স: মুক্ত উৎসের গ্রন্থসমূহ।
সম্পাদকীয় অবদান:
বিশ্বের যে কেউ এই প্রকল্পগুলিতে অংশ নিতে পারে। ব্যবহারকারীরা নতুন তথ্য যোগ করতে, বিদ্যমান তথ্য সম্পাদনা করতে এবং তথ্যের নির্ভুলতা যাচাই করতে পারেন।
উইকিপিডিয়ার কাজের প্রক্রিয়া
১. নিবন্ধ তৈরি করা
উইকিপিডিয়ায় নিবন্ধ তৈরি করতে হলে একটি নিবন্ধিত অ্যাকাউন্ট থাকা জরুরি নয়, তবে অ্যাকাউন্ট থাকলে এটি আরও সহজ এবং কার্যকর। নিবন্ধ তৈরি করতে হলে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর তথ্য সংগ্রহ করে নিরপেক্ষ ও উৎসসমৃদ্ধ উপস্থাপনা করতে হয়।
২. তথ্য সম্পাদনা করা
উইকিপিডিয়ার যেকোনো নিবন্ধে ব্যবহারকারীরা “সম্পাদনা” বোতাম ক্লিক করে তথ্য যোগ করতে বা পরিবর্তন করতে পারেন।
উৎস প্রদান: যেকোনো তথ্য যোগ করার সময় বিশ্বাসযোগ্য উৎস উল্লেখ করা প্রয়োজন।
নিরপেক্ষতা: নিবন্ধের বিষয়বস্তু অবশ্যই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করতে হবে।
৩. সমাজভিত্তিক পর্যালোচনা
নিবন্ধ তৈরির পর এটি উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়ের দ্বারা পর্যালোচনা করা হয়। যদি কোনো ভুল তথ্য বা বিতর্কিত বিষয়বস্তু থাকে, তাহলে তা সংশোধন বা অপসারণ করা হয়।
৪. বিষয়বস্তু রক্ষণাবেক্ষণ
উইকিপিডিয়া প্রশাসক এবং সক্রিয় ব্যবহারকারীরা নিবন্ধগুলোর মান রক্ষা করেন।
ভুল সংশোধন: ভুল তথ্য শনাক্ত করে তা ঠিক করা হয়।
স্প্যাম নিয়ন্ত্রণ: অনাকাঙ্ক্ষিত বা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু মুছে ফেলা হয়।
নিরপেক্ষতা বজায় রাখা: যেকোনো পক্ষপাতদুষ্ট বা বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তু সংশোধন করা হয়।
উইকিপিডিয়ার প্রযুক্তিগত ভিত্তি
উইকিপিডিয়া “মিডিয়াউইকি” নামে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে, যা এটি পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উইকি মার্কআপ: ব্যবহারকারীরা বিশেষ কোডিং পদ্ধতি (উইকি মার্কআপ) ব্যবহার করে নিবন্ধ তৈরি করেন।
সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন: সহজে তথ্য খুঁজে পাওয়ার জন্য উইকিপিডিয়ার সার্চ ইঞ্জিন অত্যন্ত কার্যকর।
কন্টেন্ট সংস্করণ: প্রতিটি সম্পাদনার রেকর্ড রাখা হয়, যা ব্যবহারকারীদের পুরোনো সংস্করণে ফিরে যেতে দেয়।
উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়ের ভূমিকা
উইকিপিডিয়া শুধুমাত্র প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল নয়; এটি একটি শক্তিশালী এবং সক্রিয় সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়।
স্বেচ্ছাসেবক: লাখ লাখ মানুষ স্বেচ্ছায় নিবন্ধ তৈরি ও সম্পাদনার কাজে যুক্ত।
প্রশাসক: বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যবহারকারীরা নিবন্ধের গুণগত মান বজায় রাখতে কাজ করেন।
আলোচনার পাতা: নিবন্ধের গুণগত মান ও নির্ভুলতা নিয়ে ব্যবহারকারীরা আলোচনা করতে পারেন।
উইকিমিডিয়ার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত
২০০১: উইকিপিডিয়ার জন্ম।
২০০৩: উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা।
২০০৪: উইকিমিডিয়া কমন্স চালু হয়।
২০০৬: উইকিমিডিয়া প্রথমবারের মতো বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
২০১০: উইকিমিডিয়া মোবাইল অ্যাপ চালু হয়।
২০২০: উইকিপিডিয়ার ২০তম বার্ষিকী উদযাপন।
উইকিমিডিয়ার লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ
উইকিমিডিয়ার প্রধান লক্ষ্য হল “সবার জন্য বিনামূল্যে জ্ঞান সহজলভ্য করা।” এটি এমন একটি পৃথিবী গড়তে চায়, যেখানে জ্ঞান শেয়ারিং এবং শিক্ষা গ্রহণ সবার জন্য সহজ এবং অবাধ। উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের সেবা আরও উন্নত করার চেষ্টা করছে। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তথ্যের মান উন্নয়নের দিকে কাজ করছে।
উইকিমিডিয়ার গুরুত্ব
উইকিমিডিয়া শুধু একটি সংস্থা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক আন্দোলন। এটি জ্ঞানকে সবার জন্য উন্মুক্ত করেছে, যেখানে জাতি, ভাষা বা ভৌগোলিক সীমা কোনো বাধা নয়। উইকিমিডিয়া আমাদের দেখিয়েছে, প্রযুক্তির সাহায্যে কীভাবে মানুষ একত্রিত হতে পারে এবং একটি বৃহৎ, সম্মিলিত জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে তুলতে পারে। এটি শুধুমাত্র তথ্য শেয়ারিং নয়, এটি এক ধরনের শিক্ষা এবং সংস্কৃতির বিপ্লব।
উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন এবং এর প্রকল্পসমূহ মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে এবং শিক্ষা গ্রহণের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জ্ঞান শেয়ার করার মাধ্যমে আমরা কেবলমাত্র নিজেদের সমৃদ্ধ করি না, বরং একটি সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়ে তুলি।