শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫

তারা ও গ্রহ: দুটোর পার্থক্য কী?

তারা ও গ্রহ
জগৎ-ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যময় দিকগুলো আমাদের মুগ্ধ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। রাতের আকাশে তারা ও গ্রহের ঝলমলে উপস্থিতি আমাদের কৌতূহলকে জাগ্রত করে। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে তারা এবং গ্রহের মধ্যে গভীর পার্থক্য রয়েছে। চলুন, এই পার্থক্যগুলো বিশ্লেষণ করি এবং জেনে নিই আমাদের মহাবিশ্বের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের প্রকৃতি।

তারা কী?
তারা হলো বিশালাকার গ্যাসের গোলক যা নিজের মধ্যে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় জ্বলে ওঠে এবং আলো ও তাপ উৎপন্ন করে। একটি তারা প্রধানত হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাস দিয়ে গঠিত। তারা তাদের কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে। এই প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হয়ে হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয় এবং প্রচুর পরিমাণ শক্তি নিঃসৃত হয়। সূর্য আমাদের নিকটতম তারা এবং এটি আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য শক্তির উৎস। তারা আকাশে স্থির বলে মনে হলেও বাস্তবে তারা মহাশূন্যে দ্রুতগতিতে চলাচল করছে। তাদের দূরত্ব এত বেশি যে তাদের গতি আমরা খালি চোখে বুঝতে পারি না। তারা সাধারণত তাদের নিজস্ব আলো নিঃসরণ করে এবং নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ বলের অধীনে থাকে।

গ্রহ কী?
গ্রহ হলো মহাকাশে উপস্থিত এমন একধরনের জ্যোতিষ্ক, যা তারার চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। গ্রহ নিজের থেকে আলো বা তাপ উৎপন্ন করতে পারে না; তারা শুধুমাত্র নিকটবর্তী তারার আলো প্রতিফলিত করে। গ্রহ গঠিত হয় কঠিন পদার্থ, গ্যাস, বরফ এবং ধূলিকণা দিয়ে। গ্রহগুলো তাদের নিজস্ব কক্ষপথে ঘোরে এবং এই কক্ষপথে তাদের মাধ্যাকর্ষণ বলের মাধ্যমে ভারসাম্য বজায় রাখে।

পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি—এই ধরনের গ্রহগুলোর নিজস্ব বায়ুমণ্ডল এবং ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলোর ভূপৃষ্ঠে জলের উপস্থিতি, তাপমাত্রা এবং বায়ুর চাপের মতো বৈশিষ্ট্য গ্রহকে বসবাসযোগ্য করে তোলে বা বসবাসের অনুপযোগী করে তোলে।

আলো উৎপন্নের ক্ষমতা

রাতের আকাশে উজ্জ্বল তারার ঝিলিক এবং গ্রহের স্নিগ্ধ আলোকচ্ছটা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তবে তাদের আলো কিভাবে সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল থাকতে পারে। তারা এবং গ্রহের মধ্যে আলো উৎপন্নের ক্ষমতার দিক থেকে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। এই পার্থক্যের পেছনে রয়েছে তাদের ভৌত গঠন এবং প্রাকৃতিক কার্যকলাপের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তারা নিজস্ব আলো এবং তাপ উৎপন্ন করতে সক্ষম, কিন্তু গ্রহ এ ধরনের ক্ষমতা রাখে না। গ্রহ কেবলমাত্র তারার আলো প্রতিফলিত করে।

তারা: নিজস্ব আলো উৎপন্নের শক্তি
তারা হলো মহাবিশ্বের শক্তির উৎস। এটি নিজের ভেতরে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আলো ও তাপ উৎপন্ন করে। এই প্রক্রিয়ায় তারার কেন্দ্রে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো বিশাল তাপমাত্রা এবং চাপের অধীনে মিলিত হয়ে হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়। এই বিক্রিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে, যা আলোর রূপে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সূর্য একটি তারা। এটি প্রতি সেকেন্ডে কয়েক মিলিয়ন টন হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে রূপান্তরিত করে এবং এর মাধ্যমে তাপ ও আলো উৎপন্ন করে। সূর্যের আলো আমাদের গ্রহে জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য।

গ্রহ: প্রতিফলিত আলো
গ্রহের নিজস্ব আলো উৎপন্নের কোনো ক্ষমতা নেই। তারা মূলত নিকটবর্তী তারার আলো প্রতিফলিত করে আলোকিত হয়। যখন সূর্যের আলো কোনো গ্রহে পড়ে, তখন সেই আলো গ্রহের পৃষ্ঠ বা বায়ুমণ্ডল থেকে প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলিত আলোই আমরা পৃথিবী থেকে দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ, চাঁদকে আমরা উজ্জ্বল দেখতে পাই, কারণ এটি সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে। একইভাবে, মঙ্গল, বৃহস্পতি বা শনি গ্রহের আলো তাদের পৃষ্ঠ বা বায়ুমণ্ডল থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো।

আলো উৎপন্নের পার্থক্যের কারণ
তারা ও গ্রহের মধ্যে আলো উৎপন্নের ক্ষমতার পার্থক্য মূলত তাদের গঠন এবং অবস্থানের ওপর নির্ভর করে।

১. গঠন: তারা প্রধাণত হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের মতো হালকা গ্যাস দিয়ে তৈরি। এই গ্যাসগুলো তারার কেন্দ্রে পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে। অন্যদিকে, গ্রহ কঠিন পদার্থ, তরল এবং গ্যাসের মিশ্রণে গঠিত, যা নিউক্লিয়ার ফিউশনের জন্য উপযুক্ত নয়।

২. আকার ও ভর: তারা অনেক বড় এবং এর মাধ্যাকর্ষণ বল এত শক্তিশালী যে এটি কেন্দ্রীয় তাপমাত্রা এবং চাপকে নিউক্লিয়ার ফিউশনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
গ্রহের আকার ও ভর এত ছোট যে এটি ফিউশনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপ ও চাপ তৈরি করতে পারে না।

৩. স্থান: তারা মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করে এবং তাদের চারপাশে গ্রহগুলো প্রদক্ষিণ করে। গ্রহ তারার কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে তার আলো প্রতিফলিত করে।

তারার আলো বনাম গ্রহের আলো
তারার আলো নিজের শক্তি উৎপাদনের ফল এবং এটি ক্রমাগত মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই আলো শক্তিশালী এবং বহুদূর পর্যন্ত দৃশ্যমান।
অন্যদিকে, গ্রহের আলো শুধুমাত্র প্রতিফলিত হওয়া সূর্যালোক। এটি তুলনামূলক কম উজ্জ্বল এবং অনেক দূরের অবস্থান থেকে সহজে দেখা যায় না।

২. গঠন ও উপাদান: তারা প্রধানত গ্যাস (হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম) দিয়ে গঠিত, যেখানে গ্রহ কঠিন পদার্থ, তরল এবং গ্যাসের মিশ্রণে তৈরি হয়।

৩. কেন্দ্রীয় অবস্থান: তারা মহাবিশ্বের কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে কাজ করে, যেখানে গ্রহ তাদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে।

৪. কক্ষপথ: তারাকে কেন্দ্র করে গ্রহ তাদের কক্ষপথে চারপাশে ঘোরে।

৫. আকার ও ভর: তারা সাধারণত অনেক বড় এবং ভারী, যেখানে গ্রহ আকারে ছোট।

৬. জন্ম ও মৃত্যু: তারা তাদের জীবনের শেষ পর্যায়ে সুপারনোভা, নিউট্রন তারা, বা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে। গ্রহের ক্ষেত্রে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক পরিণতি ঘটে না।

তারা এবং গ্রহ আমাদের মহাবিশ্বের জটিলতা এবং সৌন্দর্যের দুই দিক। তারা আমাদের আলোর উৎস এবং মহাজাগতিক শক্তির প্রদীপ। অন্যদিকে, গ্রহ আমাদের জীবনধারণের স্থান। এই পার্থক্যগুলো আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীরতর উপলব্ধি অর্জনে সহায়তা করে। তাই, তারাদের দিকে তাকিয়ে আমরা জীবন ও প্রকৃতির অসীম রহস্যের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি এবং গ্রহের দিকে তাকিয়ে আমাদের অস্তিত্বের মূল্যায়ন করি।

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Email
স্বর্ণ কেনো এতো দামী
বিজ্ঞান

স্বর্ণ কেনো এতো দামী? স্বর্ণের উৎপত্তি, ব্যবহার ও গুরুত্ব

স্বর্ণ বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান ধাতু, যা প্রাচীনকাল থেকে মানুষের কাছে সমাদৃত। স্বর্ণের উচ্চমূল্যের কারণ বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, স্বর্ণের প্রাপ্যতা খুবই সীমিত।

Read More »
মস্তিষ্ক কাচে পরিণত
বিজ্ঞান

মানুষের মস্তিষ্ক কাচে পরিণত হয়েছে আগ্নেয়গিরির তাপের প্রভাবে

মস্তিষ্ক কাচে পরিণত হয় প্রায় ২,০০০ বছর আগে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে প্রাণ হারানো এক যুবকের। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, তার মস্তিষ্ক সংরক্ষিত হয়েছিল এবং উচ্চ তাপমাত্রার

Read More »
চার্লস ডারউইন
বিজ্ঞান

চার্লস ডারউইন: আধুনিক জীববিজ্ঞানের পথিকৃৎ

চার্লস ডারউইন Charles Darwin (১৮০৯-১৮৮২) ছিলেন একজন ইংরেজ প্রকৃতিবিদ, ভূতত্ত্ববিদ এবং জীববিজ্ঞানী, যিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। তাঁর গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ আধুনিক

Read More »
রিগেল
মহাবিশ্ব

নীল অতিদানব তারা রিগেল: এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

রিগেল (Rigel) এক বিশাল নীল অতিদানব (Blue Supergiant) তারা, যা পৃথিবী থেকে প্রায় ৮৬০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটি ওরিয়নের প্রধান উজ্জ্বল তারাগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং

Read More »
অ্যান্ড্রোমিডা
মহাবিশ্ব

অ্যান্ড্রোমিডা: আমাদের সাথে সংঘর্ষে জড়াবে যে গ্যালাক্সি

অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি, যা এম৩১ (M31) নামেও পরিচিত, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সবচেয়ে নিকটবর্তী বৃহৎ প্রতিবেশী। এটি রাতের আকাশে খালি চোখেও দেখা যায় এবং মহাবিশ্বের বিস্ময়কর এক

Read More »
গ্রহাণু
মহাবিশ্ব

বড়দিনে পৃথিবীর কাছ দিয়ে অতিক্রম করবে ১০তলা ভবন সমান গ্রহাণু!

নাসার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ক্রিসমাস ইভে ১০-তলা ভবনের সমান আকারের একটি গ্রহাণু, ২০২৪ এক্সএন১, পৃথিবীর কাছ দিয়ে নিরাপদে অতিক্রম করবে। প্রায় ৩৭

Read More »
আগুন
বিজ্ঞান

আগুন আসলে কী?

আগুন এমন এক জিনিস যা দেখলে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। এর নাচানাচি, উজ্জ্বলতা, শক্তি এবং রহস্যময়তা আমাদের মোহিত করে। কখনও বিপজ্জনক, কখনও প্রশান্তিদায়ক—আগুন আমাদের জন্য

Read More »
মহাকাশে সেলফোন
প্রযুক্তি

মহাকাশে সেলফোন কীভাবে সম্ভব?

মহাকাশে সেলফোন ব্যবহার করার ধারণাটি কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনালেও বর্তমানে এটি সম্ভব হয়ে উঠেছে নাসার গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নতির মাধ্যমে। মহাকাশে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয় স্যাটেলাইট

Read More »
মহাকাশ মিশন
প্রযুক্তি

ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ১০ মহাকাশ মিশন

মানবসভ্যতার ইতিহাসে মহাকাশ মিশনগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রযুক্তি, জ্ঞান এবং গবেষণার উন্নতির পাশাপাশি মহাকাশ অভিযানের খরচও আকাশচুম্বী। এ পর্যন্ত চালানো মিশনগুলোর মধ্যে কিছু মিশন এতটাই ব্যয়বহুল

Read More »
পার্কার সোলার প্রোব
বিজ্ঞান

পার্কার সোলার প্রোব: সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছে ইতিহাস গড়ল নাসা

নাসার মহাকাশযান ‘পার্কার সোলার প্রোব’ সম্প্রতি সূর্যের সর্বাধিক নিকটবর্তী অবস্থানে পৌঁছে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সময় ২৭ ডিসেম্বর, শুক্রবার, সকাল ১১টায় প্রোবটি সূর্যের

Read More »